পরচুলার ব্যবসা- রপ্তানি পন্য হিসেবে অপার সম্ভাবনার খাত
চুল নিয়ে যুগে যুগে মানুষের আবেগের কমতি নেই। নেই বলেই উপন্যাসের পাতা থেকে গানের খাতা দখল করে আছে এই চুল। দেশ থেকে বিদেশ, কোথাও এর ব্যাতিক্রম নয়। দেবতা জুপিটারকে বিয়ের রাতে আদি রোম রমণীরা চুলের গুচ্ছ উৎসর্গ করত। অন্যদিকে কবি বললেন, “চুল তার কবেরকার, অন্ধকার বিদিশার নিশা”! ওদিকে বাংলা পল্লীগীতিতে শুনি, “বড়লোকের বেটি লো লম্বা লম্বা চুল এমন মাথায় বেধে দেব লাল গেন্দা ফুল”! বাচ্চারাও খেলে আর ছড়া পড়ে।, “চুলটানা বিবিয়ানা, সাহেব বিবির বৈঠকখানা। সাহেব বলেছে যেতে, পান সুপারি খেতে”
শুধু কি তাই? রুপকথার রুপাঞ্জেলের চুলের দৈর্ঘ্যের প্রেমেও পড়েছি আমরা বারবার!
কিন্তু এই আহল্লাদের চুলই যদি পড়তে থাকে, তখন কপালে ভাঁজ পড়া ছাড়া উপায় কী? আর এই চিন্তার অবসান করতেই প্রাচীন মিশরে আবিষ্কৃত হয়েছিল পরচুলা। তবে সময়ের আজব খেলায় সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি এটি একসময় আভিজাত্যের প্রতীকও হয়ে উঠে। আর চাহিদার সাথে সাথে প্রতিষ্ঠিত হয় পরচুলার ব্যবসা।
কিভাবে শুরু হয় পরচুলার ব্যবহার?
অত্যধিক তাপ, উষ্ণ আবহাওয়া ও সংক্রামক চর্মরোগের হাত থেকে বাঁচার জন্য মিশরের লোকরা চুল কামিয়ে ফেলতো। আর মাথার টাক ঢাকার জন্য পরচুলা ব্যবহার করত। পরবর্তীতে ফরাসিদের হাত ধরে জনপ্রিয় হয় পরচুলা। একটি তথ্য এখানে না দিলেই নয়, যৌনব্যাধি সিফিলিসের কারনে ইউরোপে পরচুলার চাহিদা বাড়ে এবং বাজার পায় পরচুলার ব্যবসা। সিফিলিসের কারণে সেই সময় অঙ্গহানি বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটতো। অষ্টাদশ শতকে এসে এই রোগের চিকিৎসা নতুন মোড় নেয় এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে পারদের ব্যবহার শুরু হয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে রোগীর মাথায় দগদগে ঘা, চুল পড়ে যাওয়া ইত্যাদি দেখা দেয়। সামাজিকভাবে অপদস্ত হবার থেকে রক্ষা পেতে পরচুলা ব্যবহার শুরু করে ইউরোপীয়রা। আরেকটি মজার তথ্য হলো ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই পরচুলা ব্যবহার করতে শুরু করলে এটি আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে শুরু করে পরচুলার ব্যবসা।
আরও পড়ুন- সহজ ১০টি ব্যবসা।
বাংলাদেশে পরচুলার ব্যবসা
পরচুলার ব্যবসা এখন বাংলাদেশেও সম্ভাবনার মুখ দেখছে। ফেলনা জিনিস থেকে হাতছানি দিচ্ছে বার্ষিক ৮৫ হাজার কোটি টাকার পরচুলার ব্যবসা! পরিপূর্ণ শিল্পের রুপ না পেলেও অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের উৎস হয়ে উঠছে দিন দিন। তা কিভাবে সংগ্রহীত হয় এই চুল? মূলত বাসাবাড়ি, বিউটি পারলার ও ময়লার স্তুপ থেকে ফেলে দেওয়া চুল একত্র করেন হকাররা। নানা হাত ঘুরে থানা, জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ের পর রাজধানীর মহাজনরা পায় তাদের কাংখিত কাঁচামাল চুলের দেখা। মহাজনরা সংগৃহীত চুলের ২০ শতাংশ পরচুলা তৈরিকারকদের কাছে বিক্রি করেন এবং ৮০ শতাংশ চীনে পাঠান। মানের উপর ভিত্তি করে এক কেজি চুলের দাম ২০০ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। প্রক্রিয়াজাত করলে দাম আরো বেড়ে যায়। তখন এক কেজি ১৫ থেকে ৩০০ ডলারে বিক্রি করা সম্ভব।
চুল সংগ্রহ তো হলো তবে তা ব্যবহার উপযোগী করে তোলা আরেক বিশাল কাজ। চুল কারখানায় এনে প্রথমে জট ছাড়ানো হয়, যাকে বলে সোর্টিং। এরপর আসে শ্যাম্পু ও বিভিন্ন মেডিসিন ব্যবহার করে পরিস্কার করার পালা। ধুয়ে প্রক্রিয়াজাত করা শেষে, এসব চুল দিয়ে হেয়ার ক্যাপ বানানো হয়। শুনতে সহজ মনে হলেও চুল সংগ্রহের পর থেকে রীতিমতো এক কর্মযজ্ঞ চলে। একেকটি পরচুলা প্রায় ১৫ থেকে ২০টি ধাপ শেষে তৈরি হয় । অনেকে বাংলাদেশের পরচুলার ব্যবসা সম্পর্কে জানেন না। তাই বেশি খরচ করে বিদেশ থেকে পরচুলা আনিয়ে ব্যবহার করেন। অথচ দেশের পরচুলার ব্যবসায়ীরা দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন চীন, আমেরিকা, সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরাক, লেবাননসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছেন।
দেশে পরচুলার সংগ্রহ সম্পর্কিত তথ্য
পরচুলার ব্যবসা এ চুল সংগ্রহের ব্যাপারে কিছু জরুরি আর মজার তথ্য দেই। রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলো থেকে বেশি ও ভালো মানের চুল পাওয়া যায়। এসব এলাকার মানুষ চুলের যত্ন নেন বলেই এমন হয়। অন্যদিকে, নদী এলাকার মানুষের চুল পড়ে বেশি। এ কারণে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে চুল সংগ্রহের পরিমাণ আবার বেশি। পরচুলার ব্যবসা শীতকালের তুলনায় গ্রীষ্মকালে বেশি হয়। শীতকালে মানুষ বিভিন্ন টুপি পরে বলে বছরের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চাহিদা কম থাকে। আবার মার্চ থেকে বাড়তে থাকে এই চাহিদা।
পরচুলার ব্যবসাতে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান
ধীরে ধীরে হলেও পরচুলার ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটি ভালো অবস্থান তৈরি করছে। আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক দুইভাবেই এখনো পর্যন্ত পরচুলার ব্যবসা চালু আছে। তাই হয়তো বা এই ব্যবসায়ের বর্তমান সম্ভাবনা অথবা অবস্থা সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরা সম্ভব না। তবুও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) দেয়া তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলারের পরচুলা রপ্তানি করা হয়েছে। যেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। হিসেব মতে ১ বছরে ১৬ শতাংশ রপ্তানি বেড়েছে। আরো বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক রপ্তানি ক্ষেত্রের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লেনদেনও হয়েছে। বরং আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে লেনদেন করে ব্যবসায়ীরা কম পরিমাণে ক্লায়েন্ট পান।
তবে কিছু কারণে এই ব্যবসায় ব্যবসায়ীদের আশা অনুসারে বড় হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে কিছু সরকারি সাহায্যের অভাব সবকিছুই এর পিছনে কারণ হিসেবে কাজ করছে। দেশের সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ মূলত এখনো পর্যন্ত জানেই না তাদের ফেলে দেওয়া মাথার চুল দেশের জন্য কতখানি আশীর্বাদ বয়ে নিয়ে আসতে পারে।
বাংলাদেশে পরচুলা ব্যবসায়ে সমস্যা
পরচুলার ব্যবসার জন্য দেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব আছে। যেমন এই সম্ভাবনাময় ব্যবসার জন্য কোন সরকারী ঋণ সুবিধা বা রপ্তানির ওপর ক্যাশ ইনসেন্টিভ সুবিধা নেই। সাথে আছে দক্ষ শ্রমিকের অভাব। বিভিন্ন আপডেটেড কেমিক্যাল, যেগুলো বিদেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করে, সেগুলোও পাওয়া যায় না। তাই কোয়ালিটিতে ঘাটতি থেকে যায়। অথচ অনেক চীনা ব্যবসায়ী বাংলাদেশ থেকে ‘র হেয়ার’ কিনে তাদের ফ্যাক্টরিতে প্রক্রিয়াজাত করে এবং ইউরোপ, আমেরিকাতে বেশি দামে বিক্রি করে।
দেশে পরচুলার ব্যবসা সম্প্রসারনে করণীয়
বিশ্বজুড়ে পরচুলার চাহিদা মাথায় রেখে বাংলাদেশের পরচুলার ব্যবসা শক্তিশালী করতে হলে, প্রথমত ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে পরচুলা ব্যবসার কাঁচামাল চুল, অনেক বেশি পরিমাণে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। এরপর সরকারকে ব্যবসায়ীদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ঋণ ও ইনসেন্টিভ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। থাকতে হবে আপডেটেড কেমিক্যাল ও অন্যান্য জিনিসপত্র আমদানির সুবিধা।
তাছাড়া উন্নত দেশগুলোর মত পরচুলার মেলা করতে পারলে ব্যবসায়ীরা যেমন উৎসাহ পাবেন, তেমনি বিদেশি ক্রেতাদের নজরেও আসা যাবে। তবে তার আগে অবশ্যই এই ব্যবসা নিয়ে দেশের মধ্যেই যথেষ্ট পরিমাণে গবেষণা ও কাজ হওয়ার দরকার আছে। এভাবে পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করলে বছরের মধ্যে পরচুলা ব্যবসা বাংলাদেশের রপ্তানি জগতের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত হতে পারে।