১০টি লাভজনক রপ্তানি ব্যবসা এবং কিভাবে শুরু করবেন?
বিশ্ববাজারে নিজের অবস্থান তৈরী করতে চান? রপ্তানি ব্যবসা হতে পারে আপনার সেই সম্ভাব্য পথ! আমাদের দেশীয় পণ্যগুলোর সুনাম তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ভাবুন তো, আপনার ব্যবসা যদি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে, কেমন হবে ব্যাপারটা?
নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য এখন সময়টা একদম পারফেক্ট। গ্লোবালাইজেশনের যুগে ব্যবসা করা আগের চেয়ে কত সহজ হয়ে গেছে! কিন্তু সমস্যা হলো, কোথা থেকে শুরু করবেন? কোন পণ্য নিয়ে এগোবেন? কোন ব্যবসায় লাভ বেশি? এইসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়, তাই না?
চিন্তার কিছু নেই। আজ আমি আপনাদের জন্য এনেছি নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ১০টি লাভজনক রপ্তানি ব্যবসা এর আইডিয়া। প্রতিটি ব্যবসার সুবিধা, চ্যালেঞ্জ আর কেন এটি আপনার জন্য উপযুক্ত হতে পারে—সবই বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো।
আগে জেনে নেই রপ্তানি ব্যবসা কি?
”আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রপ্তানি হল একটি দেশে উৎপাদিত পণ্য অন্য দেশে বিক্রি করা বা অন্য দেশের নাগরিক বা বাসিন্দাদের জন্য পরিষেবা সরবরাহ করা। ” (Source- Wikipedia)
তাহলে চলুন, শুরু করা যাক, জেনে নিই কোন কোন ব্যবসা রপ্তানির জন্য সম্ভাবনাময় এবং কিভাবে রপ্তানি ব্যবসা শুরু করবেন।
গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল পণ্য
পোশাক আমাদের অন্যতম রপ্তানি ব্যবসা যা বর্তমানে আমাদের দেশীয় মোট রপ্তানি আয়ে প্রায় ৮১% অবদান রাখে। আমাদের দেশের পোশাক শিল্পের কথা কে না জানে! বাংলাদেশি পোশাকের কদর সারা বিশ্বেই রয়েছে। আপনি সহজেই স্থানীয় কারখানা থেকে পোশাক সংগ্রহ করে বিদেশে রপ্তানি করতে পারেন। ইউরোপ, আমেরিকা—সব জায়গায় আমাদের পোশাকের চাহিদা তুঙ্গে। আর হ্যান্ডমেড কাপড়, সিল্ক, দেশীয় নকশার পণ্যের তো আলাদা কদর আছে।
চামড়াজাত পণ্য
বাংলাদেশি চামড়ার জুতা, ব্যাগ, বেল্ট—এসব পণ্যের গুণমানে কেউ টেক্কা দিতে পারবে না। স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল সহজলভ্য, উৎপাদন খরচও কম। তাই চামড়াজাত পন্যের রপ্তানি ব্যবসা করলে ভালো লাভের আশা করা যায়। ইউরোপ আর এশিয়ার অনেক দেশে আমাদের চামড়াজাত পণ্যের ভালো চাহিদা রয়েছে।
হস্তশিল্প এবং কারুশিল্প
পাটের ব্যাগ, বাঁশের সামগ্রী, কাঠের ঘর সাজানোর জিনিস—এসব হস্তশিল্পের জিনিসপত্র বিদেশিদের খুবই পছন্দ। স্থানীয় কারিগরদের সাথে কাজ করে আপনি এসব পণ্য রপ্তানি করতে পারেন। অনলাইন মার্কেটপ্লেস যেমন Etsy-তে তো আমাদের হস্তনির্মিত পণ্যের কদর আকাশচুম্বী।
পাট এবং পাটজাত পণ্য
পাটকে বলা হয় “সোনালী আঁশ”। পাটের তৈরি ব্যাগ, দড়ি, ম্যাট—এসব পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ইউরোপ, জাপান, কানাডা—সব জায়গায় আমাদের পাটজাত পণ্যের সুনাম রয়েছে। ব্যবসা শুরু করতে বেশি ঝামেলাও নেই।
আইটি ও সফটওয়্যার সেবা
আইটি সেক্টরে আমরা কিন্তু অনেক দূর এগিয়েছি। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং—এসব সেবা রপ্তানি করে ভালোই আয় করা যায়। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার ক্লায়েন্টরা আমাদের কাজের ওপর ভরসা করে। আপনার যদি আইটি দক্ষতা থাকে, তাহলে রপ্তানি ব্যবসা হিসেবে এই খাতটা আপনার জন্য পারফেক্ট।
মাছ এবং সামুদ্রিক খাদ্য
চিংড়ি, ইলিশ—আমাদের সামুদ্রিক খাদ্যের স্বাদই আলাদা। আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলোর চাহিদাও অনেক। চিংড়ি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে আমাদের অনেক সুবিধা আছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে আমাদের মাছের কদরও আছে।
বিভিন্ন ধরনের ফল ও শাকসবজি
আম, কাঁঠাল, পেঁপে—আমাদের ফলের মিষ্টি স্বাদ বিদেশিদের মুগ্ধ করে। শাকসবজি যেমন লাউ, ঢেঁড়সেরও চাহিদা রয়েছে। যদি আপনি কৃষিজাত পণ্যে হাত বাড়াতে চান, তাহলে রপ্তানি ব্যবসা (export business) হিসেবে এটি হতে পারে একটি লাভজনক ক্ষেত্র।
প্রক্রিয়াজাত খাদ্য
প্যাকেটজাত খাবার, মশলা, আচার—এসব প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের চাহিদা শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে নয়, বিদেশি ক্রেতাদের কাছেও রয়েছে। আপনি যদি খাবার নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন, তাহলে এই ব্যবসাটা ট্রাই করে দেখতে পারেন।
ঔষধ এবং স্বাস্থ্যসেবা পণ্য
আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প ক্রমশ বিকাশ লাভ করছে। আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে আমাদের ঔষধের চাহিদা রয়েছে। ঔষধ, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট রপ্তানি করে ভালো আয় করা যায়। স্বাস্থ্যসেবায় অবদান রাখতে চাইলে রপ্তানি পন্য হিসেবে এই খাতটা আপনার জন্য।
বিউটি এবং স্কিন কেয়ার পণ্য
প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি আমাদের বিউটি পণ্যের কদর দিন দিন বাড়ছে। অর্গানিক সাবান, তেল, হার্বাল ক্রিম—এসব পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা রয়েছে। সৌন্দর্য শিল্পে আগ্রহী হলে এটি হতে পারে আপনার জন্য সেরা সুযোগ।
আরও পড়ুন- ব্যবসার আইডিয়া
কিভাবে রপ্তানী ব্যবসা শুরু করবেন?
চলুন, ধাপে ধাপে দেখে নেই কীভাবে আপনি রপ্তানি ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
মার্কেট অ্যানালাইসিস করুন
প্রথমেই আপনাকে বুঝতে হবে কোন পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা আছে। আপনি যে পণ্য রপ্তানি করতে চান, সেটির বাজার, প্রতিযোগিতা, মূল্য নির্ধারণ—এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করুন।
পণ্য নির্বাচন করুন
বাজার গবেষণার পর আপনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত পণ্যটি বেছে নিন। এটা হতে পারে গার্মেন্টস, চামড়াজাত পণ্য, হস্তশিল্প, বা আগের তালিকার অন্য কোনো আইটেম।
আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করুন
রপ্তানি ব্যবসা নিয়ে কাজ শুরু করতে কিছু আইনগত কাজ করতে হবে:
- বাণিজ্য লাইসেন্স সংগ্রহ করুন: আপনার স্থানীয় সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা থেকে।
- চেম্বার অব কমার্সের সদস্যপদ নিন।
- ট্রেডমার্ক এবং ব্র্যান্ড রেজিস্ট্রেশন করুন।
ইপিবি এবং বিআইডিএ থেকে নিবন্ধন করুন
- রপ্তানি প্রমোশন ব্যুরো (ইপিবি): রপ্তানিকারক হিসেবে নিবন্ধন করতে হবে।
- বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিআইডিএ): বিনিয়োগ সংক্রান্ত নিবন্ধন করতে হবে।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলুন
রপ্তানি ব্যবসা নিয়ে কাজ করতে গেলে আপনার আন্তর্জাতিক লেনদেন করা লাগবে। আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য একটি বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণের উপযোগী ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। নিশ্চিত করুন যে ব্যাংকটি এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক পেমেন্ট প্রক্রিয়া সমর্থন করে।
পণ্য প্রস্তুত করুন
- মান নিয়ন্ত্রণ: আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে।
- প্যাকেজিং এবং লেবেলিং: বিদেশি বাজারের নিয়ম মেনে করতে হবে।
- সাপ্লাই চেইন স্থাপন করুন: স্থানীয় সরবরাহকারীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলুন।
ক্রেতা অনুসন্ধান করুন
- বাণিজ্য মেলা ও প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করুন।
- অনলাইন মার্কেটপ্লেসে (যেমন Alibaba, GlobalSources) প্রোফাইল তৈরি করুন।
- সোশ্যাল মিডিয়া এবং নিজের ওয়েবসাইট ব্যবহার করুন।
মূল্য এবং শর্তাবলী নির্ধারণ করুন
- মূল্য নির্ধারণ করুন: প্রতিযোগিতামূলক এবং লাভজনক হতে হবে।
- পেমেন্ট শর্তাবলী ঠিক করুন: এলসি, টিটি, বা অন্য কোনো পেমেন্ট মেথড।
- ডেলিভারি শর্তাবলী নির্ধারণ করুন: ইনকোটার্মস (FOB, CIF ইত্যাদি) বুঝে নিন।
শিপমেন্ট এবং লজিস্টিকস নির্বাচন করুন
- ফরওয়ার্ডার নির্বাচন করুন: যারা পণ্য পরিবহন এবং কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে সাহায্য করবে।
- কাস্টমস ডকুমেন্টেশন প্রস্তুত করুন: কমার্শিয়াল ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট, বিল অব লেডিং ইত্যাদি।
বীমা করুন
এটি রপ্তানি ব্যবসা করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। তাই পণ্যের নিরাপত্তার জন্য বীমা করিয়ে নিন। শিপমেন্টের সময় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বীমা আপনার ক্ষতি পুষিয়ে দেবে।
কাস্টমস এবং শুল্ক বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করুন
রপ্তানি-আমদানির শুল্ক, কর, এবং কাস্টমস নিয়ম সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখুন। প্রয়োজনে কাস্টমস এজেন্টের সাহায্য নিতে পারেন।
সম্পর্ক বজায় রাখুন
একবার ক্রেতা পেয়ে গেলে তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখুন। সময়মতো পণ্য ডেলিভারি, মান বজায় রাখা এসব বিষয় গুরুত্ব সহকারে পালন করুন।
ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করুন
ব্যবসা শুরু করার পর নতুন বাজার এবং পণ্য নিয়ে ভাবুন। ক্রেতাদের ফিডব্যাক নিয়ে পণ্যের মান উন্নয়ন করুন।
শেষ কথা
রপ্তানি ব্যবসা নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। সঠিক পরিকল্পনা আর বাজার গবেষণা থাকলে আপনি সহজেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখতে পারেন। তবে হ্যাঁ, রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আর নিয়মকানুন সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেয়া জরুরি। মান নিয়ন্ত্রণ আর সময়মতো পণ্য ডেলিভারি—এই দুটো বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখলে সাফল্য আপনার হাতের মুঠোয়।
নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার যাত্রা হোক সাফল্যমণ্ডিত আর সুখময়! এগিয়ে যান, বিশ্ব অপেক্ষায় আছে আপনার পণ্যের জন্য!