গরুর ওমাসম ও পিজল এর ব্যবসা, বিপুল বৈদেশিক বানিজ্যের হাতছানি
বর্তমান বিশ্বে খাদ্য সহ সকল ধরনের ব্যবসাতে নানা রকম ভিন্নতা দেখা দিচ্ছে। এক সময় হয়তোবা যে সকল ব্যবসার কথা মানুষ কল্পনাতে আনেনি সেই সব ধরনের ব্যবসার আইডিয়া আজকের দিনে এসে সফল ব্যবসায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এর মধ্যে আরো মজার ব্যাপার হলো এমন কিছু ব্যবসায় বর্তমান সময়ে এসে বেশ লাভজনক হচ্ছে যার মূল উপাদান এক সময় হয়তো বা রীতিমতো ফেলে দেওয়ার যোগ্য জিনিস ছিল।
আজ এমনই একটি ব্যবসার আইডিয়া নিয়ে কথা হবে।
গরুর ওমাসম এবং পিজল এর ব্যবসা- অপ্রচলিত একটি অসাধারন ব্যবসার আইডিয়া
গরু আমাদের দেশে অত্যন্ত পরিচিত ও গৃহপালিত একটি পশু৷ শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবী জুড়েই গরুর নানা কারণে চাহিদা রয়েছে৷ প্রথমত রয়েছে দুধ যা খুবই পুষ্টিকর একটি খাদ্য। ঠিক এর পরেই বিভিন্ন দেশের এর মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এরপর যদি বলি গরুর চামড়ার কথা তাও কিন্তু অনেক ব্যবসায়ের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল। এছাড়া গরুর শিং কিংবা খুর দিয়েও নানারকম ব্যবসার যোগান দেয়া হয়। আর মুসলিম দেশগুলোতেও তো কোরবানি মানে গরুর কারণে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।
এর বাইরে অনেকে গরুর নাড়ি ভুঁড়ি বা বট খেয়ে থাকেন। যদিও গরুর মাংসের তুলনায় এই নাড়ি ভুঁড়ি পছন্দ করা মানুষের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু এখন যদি বলি এই গরু জবাইয়ের পর এর তৃতীয় পাকস্থলী (ওমাসম) ও সাথে পেনিস (পিজল) একটি বিশাল ব্যবসায় ক্ষেত্র তৈরি করছে, তাহলে কি অবাক হবেন?
হ্যাঁ এই অবাক করা বিষয়টি গত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের ব্যবসায় জগতে ঘটে গেছে। জন্ম নিয়েছে ওমাসম এবং পিজল ব্যবসা এর মত এক দারুণ ব্যবসার আইডিয়া। যদিও এর শুরুর গল্পটা আরো পুরনো।
কিভাবে বাংলাদেশে শুরু হল এই ওমাসম ও পিজল এর ব্যবসা?
চট্টগ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইলিয়াছ বাংলাদেশের ওমাসম ব্যবসায় দুনিয়ার পথপ্রদর্শক। ২০০০ সালের কোন একদিন, একজন পাহাড়ি ও দুইজন বাঙালিকে তিনি দেখেন গরু জবাইয়ের পর তার নাড়িভুঁড়ি বস্তাবন্দী করে নিয়ে যেতে। কৌতূহল থেকে এর রহস্য জানতে চাইলেও উত্তর পান না। বরং নিজের আগ্রহ থেকে তাদের অনুসরণ করেন। আর ঘটনা যা বুঝেন তা হলো, টেকনাফ স্থলবন্দর হয়ে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড যায় এই নাড়িভুঁড়ি! শুধু তাই নয়, এই একই চোরাই পথে চীন পর্যন্ত পাচার হয় এই পণ্য। এভাবেই এই ব্যবসার আইডিয়া উনার মাথায় আসে তবে তার পরিকল্পনা ছিল বৈধ পথে এই ব্যবসার আইডিয়া কাজে লাগানো। তখন থেকেই চট্টগ্রাম জেলায় এই ব্যবসার যাত্রা শুরু এবং এই শহর হয়ে উঠে ওমাসম ও পিজল ব্যবসায়ের প্রাণকেন্দ্র। চট্টগ্রামের ১০ জনসহ পুরো দেশে প্রায় ৪০ জন ব্যবসায়ী গরুর ওমাসম ও পিজল রপ্তানি করছেন।
কেন ওমাসম এবং পিজল এর এত কদর? কেমন দাম?
পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোতে ওমাসম এর কদর বেশি। কোরিয়া, হংকং, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে এসব পণ্য। এর মধ্যে আবার চীন, ভিয়েতনাম ও হংকংয়ে গরুর ওমাসমের চাহিদা ভালো। এসব দেশে ওমাসম এর তৈরি সালাদ ও সুপ খুবই জনপ্রিয় একটি খাদ্য। অন্যদিকে কানাডা, আমেরিকা, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া পিজলের চাহিদা বেশি। এসব দেশে এক টন শুকনো পিজলের দাম ২০ হাজার ডলার, আর এক টন শুকনো ওমাসমের দাম ৬ হাজার ডলারের মতো।
কি পরিমাণ ওমাসম ও পিজল রপ্তানি হয় প্রতি বছর?
বর্তমানে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে এই পণ্য দু’টির কল্যাণে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। ২০২৪ সালে ২০ কনটেইনার ওমাসম বা গরুর পাকস্থলী সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। যার প্রতি কনটেইনারের মূল্য দুই লাখ ডলার। আর পিজল বা পেনিস সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০০ টন। (Source- Jagonews24)
এ খাতের সাথে জড়িত রপ্তানিকারকরা আশা প্রকাশ করেন, বর্তমানে এই খাতে প্রদেয় সরকারী প্রণোদনা ২% থেকে বাড়িয়ে ৮-১০% করলে ওমাসম ও পিজল রপ্তানি বাবদ প্রতি বছর প্রায় ৬০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
কিভাবে ওমাসম ও পিজল সংগ্রহ ও রপ্তানি হয়ে থাকে?
কসাইয়ের থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ওমাসম ও পিজল সংগ্রহ করে। তবে জবাইয়ের দুই ঘন্টার মধ্যেই এটি লবন দিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। এরপর একসাথে আড়তদারদের কাছে নিয়ে গেলে তারা এসব পিজল ও ওমাসম আরো সুন্দরভাবে প্রক্রিয়াজাত করে। এবং শেষমেষ তা বিক্রি হয় রপ্তানিকারকের কাছে। রপ্তানিকারকরা একাধিক আড়তদারের কাছ থেকে কিনে তা বিক্রয় উপযোগী করে কোল্ড স্টোরেজে রাখে। যথেষ্ট পরিমাণ ওমাসম ও পিজল সংগ্রহ শেষে তা একসাথে কন্টেইনারে করে বিদেশে রপ্তানি করে। সাধারণত স্থানীয় পর্যায়ে ওমাসম ২০০ থেকে ২২০ টাকায় এবং পিজল ৮০ থেকে ১০০ টাকায় সংগ্রহ করা হয়।
বাংলাদেশে ওমাসম ও পিজল ব্যবসায়ের সম্ভাবনা কেমন?
ওমাসম এবং পিজল ব্যবসার আইডিয়া নিয়ে তো শুনলাম। কিন্তু নতুন ব্যবসায়ীদের জন্য এই ব্যবসায় কতোটা উপযোগী? মজার ব্যাপার হল বড় আকারে প্রথমেই ঝুঁকি নিয়ে এই ব্যবসায় করার কথা যদি ভুলেও যাই, তবুও এই ব্যবসায়ের সাথে জড়িত হয়ে আয় শুরু করার উপায় আছে।
প্রথমত, অনেক মানুষই এখনও এই ব্যবসায় সম্পর্কে জানে না। তাই এইসব ফেলে দেয়া হয় ময়লার স্তূপ আর জলাশয়ে। বাংলাদেশে প্রতিদিনই যে পরিমান গরু জবাই হয় তার মাত্র ৮% থেকে ১০% ওমাসম ও পিজল রপ্তানি হচ্ছে। এমনকি কোরবানিতে জবাইকৃত গরুর ১০০ ভাগের মাত্র ১০ ভাগ ওমাসম এবং পিজল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। বাকি ৯০ শতাংশ ওমাসম ও পিজল হয় ফেলে দেয়া হচ্ছে বা সঠিকভাবে সংগ্রহের অভাবে নষ্ট হচ্ছে এবং আড়ৎদার পর্যন্ত যাচ্ছে না। জবাইকৃত গরুর ১০০ ভাগ ওমাসম ও পিজল সংরক্ষণ ও রপ্তানি করা গেলে দেশে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব। আর তার একটি ছোট অংশ শুরু করা সম্ভব নিজের এলাকা থেকেই।
তাই নিজ উদ্যোগে এলাকা ভিত্তিতে এই পণ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। এবং তা আড়ৎদারদের কাছে বিক্রি করলেই কম ঝুঁকিতে ব্যবসায়ের সাথে জড়িত হওয়া সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, এই ব্যবসায় খুবই ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। ফলে, দেশের অন্যান্য অংশে এর ব্যাপ্তি নেই বললেই চলে। তাই অন্য সব এলাকায় এই ব্যবসায় শুরু করার জন্য বিশাল সুযোগ পড়ে আছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম এর বাইরের লোকরাও ওমাসম ও পিজল রপ্তানি ব্যবসার আইডিয়া কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করতে আসলে এই খাতে বিপুল মুনাফা লাভ করা সম্ভব।
শেষকথা
এই খাতে সরকারের সুনজর এখন সময়ের দাবি। উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ব্যাংক লোন দেয়া এবং প্রয়োজনে তার পাশাপাশি নগদ সহায়তা দেয়া দরকার। তাছাড়া কর ও শুল্কের ক্ষেত্রে সহজ শর্ত, এই ব্যবসায়ীক আইডিয়াকে সফল করার আরো একটি ধাপ।
এবং সবচেয়ে জরুরি যেই কাজটি এত বছরেও হয় নি তা নিশ্চিত করা জরুরি আর তা হল, ওমাসম ও পিজল যে ফেলনা জিনিস না, এগুলো বিক্রি করে যে নিজেও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায় এবং দেশের রপ্তানি ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সাহায্য করা যায়, এই সচেতনতা গড়ে তোলা।