সাধারণ শেয়ার ও বোনাস শেয়ার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা
শেয়ার মার্কেটে নানারকম শেয়ার রয়েছে এবং প্রতিটি শেয়ারের ধরণ নিয়েই আছে নতুন নতুন জানার মতো বিষয়। কোনোটার ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য আলোকপাত করার মত, তো কোনোটার আবার সুবিধা- অসুবিধা। আজ আমরা আলাপ করবো সাধারণ শেয়ার ও এর বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ে। পাশাপাশি বোনাস শেয়ার এবং এর হিসাব কিভাবে করা হয় তাই নিয়ে। সাথে থাকছে ব্যবসা সম্প্রসারনের প্রয়োজন ছাড়াও অন্যান্য কি কি লক্ষ্য সামনে রেখে বোনাস শেয়ার দেয়া হতে পারে তার বিস্তারিত। শেয়ার ব্যবসা সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে এসব তথ্য জানা থাকলে ভালো।
সাধারন শেয়ার কাকে বলে?
একটি যৌথ মূলধনী কোম্পানি ব্যবসায় শুরু করার সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন নিয়ে নিবন্ধিত হয়। এই মূলধনের ছোট ছোট একেকটি অংশকে সাধারন শেয়ার বলে। আর কতগুলো শেয়ার একসাথে মিলে হয় স্টক। কোম্পানির প্রকৃত মালিক হলো সাধারণ শেয়ার হোল্ডাররা । কোম্পানির যা নিট লাভ তা এদের মাঝেই ভাগ হয়।
কোম্পানি আইন অনুসারে যে শেয়ার মালিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ও অধিকার, দুই-ই কোম্পানিতে বেশি থাকে আবার সাধারণ ভিত্তিতে লাভের অংশ ভোগ করে এবং যাদের মূলধন ফেরত পাওয়ার কথা থাকে, তাকে সাধারণ শেয়ার মালিক বলে। এ ধরণের শেয়ারের মালিকেরা ভাগের শেয়ারের লভ্যাংশ ভাগ হবার, পর শতকরা হারে লভ্যাংশ পায় এবং কোম্পানির কখনো বিলুপ্ত হলে সবার শেষে মূলধন ফেরত পায়।
ক্রয়কৃত শেয়ার দ্বারা সাধারণ শেয়ারের মালিকগণের দায় সীমাবদ্ধ থাকে। যার অর্থ দাঁড়ায়, যে যেই পরিমাণ শেযড়ায়,কিনবে তার দায়বদ্ধতা শুধুই ততটুকু । আশা করছি, সাধারন শেয়ার কাকে বলে এ ব্যাপারে একটা মোটামুটি ধারনা দেয়া গিয়েছে।
সাধারণ শেয়ার এর বৈশিষ্ট্যসমূহ
সাধারন শেয়ার কাকে বলে এ সংক্রান্ত আলোচনার পর এবার দেখা যাক সাধারন শেয়ার এর বৈশিষ্ট্যসমূহ কি কি? সাধারন শেয়ার এর ধরন অনুযায়ী এর বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ।
- মালিকানাঃ কেউ যদি যৌথ মূলধনী কোম্পানির সাধারণ শেয়ার ক্রয় করে, তাহলে সে ওই কোম্পানির মালিকানা পায়।
- ভোটাধিকারঃ সাধারণ শেয়ারের যারা মালিক থাকেন তারা প্রতিষ্ঠানের যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভোট দেবার অধিকার রাখেন।
- মুনাফার ওপর অধিকারঃ সাধারণ শেয়ারহোল্ডারগণই প্রতিষ্ঠানের মালিক। প্রতিষ্ঠানের মুনাফার উপর অবশ্যই তাদের অধিকার থাকে।
- ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণের অধিকারঃ সাধারণ শেয়ারহোল্ডারগণ প্রতিষ্ঠানের মালিক হবার কল্যাণে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করার অধিকার রাখেন।
- সীমাবদ্ধ দায়ঃ ক্রয় কৃত শেয়ার দ্বারা সাধারণ শেয়ার মালিকদের দায় তাদের সীমাবদ্ধ থাকে।
- অভিহিত মূল্যঃ সাধারণ শেয়ারের গায়ে লিখিত মূল্যকে ঐ শেয়ারের অভিহিত মূল্য বলে।
- বাজার মূল্যঃ সাধারণ শেয়ার সমূহ বাজারে যে মূল্যে বিক্রি করা হয় তাকে বাজারমূল্য বলে।
- লভ্যাংশঃ প্রতি বছর সাধারন শেয়ারের মালিকগণ লভ্যাংশ গ্রহণ করে থাকে যা প্রতিষ্ঠানের আয়ের একটি অংশ।
- মেয়াদকালঃ যৌথ মূলধনী কোম্পানির মেয়াদকাল ও তার সাধারণ শেয়ারের মেয়াদকাল সমান।
বোনাস শেয়ার কি?
সাধারন শেয়ার কাকে বলে এবং এর বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ে আলোচনার পরে এবার আসা যাক জেনে নিই বোনাস শেয়ার কি?
বোনাস শেয়ার হলো যখন কোম্পানির শেয়ার মালিকদের মাঝে নগদে লাভের অংশ বন্টন না করে, লভ্যাংশের বিপরীতে সাধারণ শেয়ার বণ্টন করা হয়। বোনাস শেয়ার আসলে নতুন ধরনের কোনো শেয়ার না। শেয়ার মালিকেরা কোনো অর্থের বিনিময়ে এই শেয়ার কেনেন না। এ কারনেই এর নাম বোনাস শেয়ার।
মূলত ব্যবসায় বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নগদ টাকার প্রবাহ সুরক্ষিত রাখার জন্য বোনাস শেয়ার ইস্যু করা হয়। এর ফলে ভবিষ্যতে কোম্পানির ব্যবসা ও লাভ বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে মূলধন বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি লাভ না হলে শেয়ার প্রতি আয় বা ইপিএস হ্রাস পেতে পারে। এমন অবস্থা তৈরী হলে, কোম্পানির লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষমতাও কমে যায়। তাই পরিশোধিত মূলধন বেশি বৃদ্ধি করলে দীর্ঘমেয়াদে কোম্পানির মুনাফা ও লভ্যাংশের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন হয়।
সাধারণত কোম্পানি তার ব্যবসা বাড়ানোর প্রয়োজনে সঞ্চিতির একটি অংশকে মূলধনে রূপান্তর করে। যে পরিমাণ টাকা মূলধনে রুপান্তর করা হয় তার সমপরিমাণ অর্থের শেয়ার ইস্যু করা হয় যেটা আমরা বোনাস শেয়ার বলে জানি। আর তা আনুপাতিক হারে শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে ভাগ করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, একটি কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ১০ কোটি টাকা। এবং শেয়ার সংখ্যা এক কোটি। এদিকে, কোম্পানিটির ৬ কোটি টাকার সঞ্চিতি আছে। কোম্পানির পরিচালকগন ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য সঞ্চিতি থেকে ৫ কোটি টাকা মূলধনে রূপান্তর করার পরিকল্পনা করলো। তাহলে কোম্পানিকে যা করতে হবে তা হলো ৫০ শতাংশ হারে বোনাস ঘোষণা করতে হবে। সেইক্ষেত্রে কোম্পানিটিকে নতুন করে ৫০ লাখ শেয়ার ইস্যু করার সুযোগ পাবে। এবং প্রত্যেক বিনিয়োগকারী তাদের বিও কোড এ রেকর্ড ডেট পর্যন্ত থাকা দুটি শেয়ারের বিপরীতে একটি করে বোনাস শেয়ার পাবেন। এর ফলে, বোনাসের মাধ্যমে কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা এবং পরিশোধিত মূলধন উভয়ই বেড়ে যায়।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো সাধারণত বছর শেষে তার বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়। তাই একবছর একটি কোম্পানির শেয়ার ধরে রাখতে হবে ব্যাপারটা তা নয়। মূলত কোম্পানির রেকর্ড ডেটের (শেয়ারের মালিকানা নির্ধারণের দিনের) আগে শেয়ার কিনলে ঘোষিত যে কোন কোম্পানির লভ্যাংশ প্রাপ্তির যোগ্য হিসাবে বিবেচিত হবেন একজন বিনিয়োগকারী।
নগদ বা বোনাস লভ্যাংশ কিভাবে হিসাব করবেন?
সাধারন শেয়ার কাকে বলে কিংবা বোনাস শেয়ার কি এসংক্রান্ত আলোচনা আশা করি এ ব্যাপারে একটি ধারনা দিতে সক্ষম হয়েছে। এবার আসা যাক নগদ বা বোনাস লভ্যাংশ কিভাবে হিসাব করবেন?
কর পরবর্তী যে মুনাফা থাকে সেখান থেকে কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ বিতরন করে। কেউ স্টক বা শেয়ার লভ্যাংশ হিসাবে বন্টন করে। আর কোন কোম্পানি নগদ বা টাকা মুনাফা হিসাবে করে। কিন্তু কোন কোম্পানি যদি বছর শেষে লাভ করতে না পারে তখন ক্যাটাগরি টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে রিজার্ভ (সংরক্ষিত তহবিল) থেকেও লভ্যাংশ দিতে পারে। কোম্পানির আয় বা ইপিএস নেগেটিভ হলে সাধারণত নগদ লভ্যাংশ প্রদান না করে স্টক বা বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়।
এবার আসা যাক নগদ বা বোনাস লভ্যাংশ কিভাবে হিসাব করবেন? ধরুন একটি কোম্পানি ২০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে ঘোষণা করলো এবং এর রেকর্ড ডেট ঘোষণা করলো ২০ ফেব্রুয়ারি। এখন উক্ত তারিখে আপনার বিও কোডে উক্ত কম্পানির ১০ টাকা অভিহিত মুল্যের ৫০০ শেয়ার ছিল এবং ওই শেয়ারটির প্রতিটি শেয়ার এর বাজারমুল্য ছিল ৫০ টাকা। বাজারমুল্য যাই থাকুক, এক্ষেত্রে আপনি আপনার কোডে থাকা শেয়ার এর সাথে বোনাস হিসেবে আরও ১০০ শেয়ার পাবেন।
এবার আসা যাক একই কোম্পানি যদি ২০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে ঘোষণা না করে ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে তাহলে আপনি কি পাবেন? এক্ষেত্রে ও হিসাব একই। বাজারমুল্য যাই থাকুক আপনি নগদ লভ্যাংশ পাবেন শেয়ারটির অভিহিত মুল্যের উপরে। অর্থাৎ ৫০০ শেয়ারের অভিহিত মুল্য হিসাবে ৫০০০ টাকায় আপনি নগদ লভ্যাংশ পাবেন ১০০০ টাকা। আবার এই লভ্যাংশ থেকে সরকার নির্ধারিত ট্যাক্স কেটে রাখা হবে।
ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা না থাকলেও কেনো বোনাস শেয়ার দেয়া হয়?
ব্যবসা বাড়ানোর প্রয়োজন না থাকলেও অনেক সময় বোনাস ইস্যু করা হয়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে অসাধু উদ্যোক্তা নানা নেতিবাচক উদ্দেশ্য নিয়েও এই কাজটির উদ্যোগ নেন।
তা কি কি কারণ থাকতে পারে?
প্রথমত: অনেক বিনিয়োগকারী আছেন যারা পুরনো সব মতবাদ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করেন। বিনিয়োগকারী হিসেবে লভ্যাংশের নগদ অর্থের চেয়ে বোনাসকে বেশি গুরুত্ব দেয়াই তাদের অভ্যাস। যার ফলে দেখা যায়, ভাল বোনাস দেয়ার ফলে বাজারে সে কোম্পানির শেয়ারের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়। এমনকি বেনামী শেয়ার ব্যবসা থেকে লাভ করার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক ছোট ও ব্যবসায়ীকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় নেই এমন কোম্পানিও বোনাস ইস্যু করে।
দ্বিতীয়ত: অনেক ব্যবসায়ী নগদ অর্থ হাতছাড়া করার লোভ সামলাতে পারে না বলেও বোনাস লভ্যাংশ দেওয়া হয়।
তৃতীয়ত: অনেক লসের মুখে থাকা কোম্পানির মালিকেরা কারসাজির মাধ্যমে কোম্পানিকে লাভজনক দেখায় এবং বোনাস শেয়ার ইস্যু করে।এবং শেয়ার বিক্রি করে প্রচুর অর্থ আয় করে। যদিও বাস্তবে কোম্পানিগুলো লসের মুখে থাকায় আসলে এদের পক্ষে নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা দেয়া অসম্ভব।
ইতিকথা
সাধারন শেয়ার কাকে বলে, বোনাস শেয়ার কি, কেন বোনাস শেয়ার দেয়া হয় বা কিভাবে এগুলো হিসাব করা হয় এগুলো নিয়ে আলোচনা শেষে একটি প্রশ্ন মাথায় আসতে পারে। সেটি হল লভ্যাংশ বিবেচনায় কোন টাইপের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ?
ধারাবাহিক ভাবে প্রতি বছর ১০ শতাংশের উপরে নগদ লভ্যাংশ দিয়ে থাকে এমন কোম্পানিগুলো সিংহভাগ ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ এর জন্য নিরাপদ।
আবার কখনো কোনো কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদেরকে ধারাবাহিকভাবে একইসঙ্গে নগদ লভ্যাংশ ও বোনাস শেয়ার দিয়ে থাকে। শেয়ারবাজারের অভিজ্ঞতা থেকে এসব কোম্পানিগুলোকে ভালো কোম্পানি হিসেবে বিবেচনা করা যায় এবং এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ তুলনামুলক নিরাপদ হিসেবে গন্য করা যায়।
তবে শেয়ারবাজার এ যেকোন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিজস্ব বিচার বিবেচনা, কোম্পানির আর্থিক অবস্থা, কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন, বাজারে উক্ত কোম্পানির পন্যের অবস্থান এরকম অনেক কিছুই বিবেচনা করেই বিনিয়োগ করা উচিত। কোনভাবেই গুজবনির্ভর বিনিয়োগ করে পুঁজিকে ঝুকির মুখে ফেলা উচিত নয়।
সাধারন শেয়ার এবং বোনাস শেয়ার ব্যতিত আরও একটি শেয়ার আছে যেটি শেয়ার বাজারে পরিচিত শব্দ। যেটি হল রাইট শেয়ার। এই রাইট শেয়ার কি এবং কোন ক্ষেত্রে এটি ইস্যু করা হয় এ ব্যাপারে আর একটি আর্টিকেল এ বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।