পার্টনারশিপ ব্যবসার নিয়ম কি এবং কিভাবে শুরু করবেন?
প্রথমেই জেনে নেই পার্টনারশিপ বা অংশীদারি ব্যবসা বলতে কি বোঝা যায়। ১৮৯০ সালের ব্রিটিশ অংশীদারি আইনের ১ম ধারা অনুযায়ী, ব্যবসায়ে লাভ অর্জনের লক্ষ্যে যৌথভাবে পরিচালিত ব্যবসায়ে কতিপয় ব্যক্তির মধ্যে যে সম্পর্ক স্থাপন হয় তাকে পার্টনারশিপ বা অংশীদারি বলে।
তবে, এরপর ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৪ ধারায় উল্লেখ্য করা হয়, সবার দ্বারা বা সবার পক্ষে একজনের দ্বারা পরিচালিত ব্যবসায়ের লাভ বা মুনাফা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে একাধিক ব্যক্তির মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাকে পার্টনারশিপ বা অংশীদার বলে। আর যারা এই অংশীদারির সম্পর্ক সৃষ্টি করে, তাদের প্রত্যেককে অংশীদার এবং সম্মিলিতভাবে তাদের ব্যবসায়কে পার্টনারশিপ বা অংশীদারি ব্যবসায় বলে।
পার্টনারশিপ ব্যবসার প্রথম নিয়ম হলো কমপক্ষে ২ জন এবং সর্বোচ্চ ২০ জন ব্যক্তি ব্যবসায়ে লাভ করার উদ্দেশ্যে এক হোন এবং এরপর চুক্তির মাধ্যমে আইনসংগতভাবে যুক্ত হোন। তবে, ব্যাংকিং ব্যবসার ক্ষেত্রে পার্টনারের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০ জন হতে পারবে। পার্টনাররা প্রথমে মৌখিকভাবে নিজেদের ব্যবসার প্রকার থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা কি কি মেনে চলবেন এবং ব্যবসায়টি কি উপায়ে পরিচালনা করবেন তা আলোচনা করেন। এরপর ব্যবসা গঠনের পূর্বে সবকিছুই লিখিত আকারে নির্ধারণ করা হয়।
পার্টনারশিপ ব্যবসার নিয়ম গুলো কি কি এবং কিভাবে শুরু করবেন?
পার্টনারশিপ ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে।
পার্টনারশিপ ব্যবসার মূল ভিত্তি হলো চুক্তিপত্র। পার্টনারশিপ ব্যবসার নিয়ম পরিচালনার ক্ষেত্রে কি কি হবে, অংশীদাররা কীভাবে নিজেদের মধ্যে অংশ বণ্টন করবেন, কার্যক্রম কি কি হবে এবং কে কোন দ্বায়িত্ব নিবেন,সবকিছুই চুক্তিপত্রের মধ্যে উল্লেখ থাকতে হবে।
শুধু তাই নয়, পার্টনারশিপ ব্যবসার নিয়ম হলো চুক্তিপত্র এমনভাবে লেখা হবে যে, অদূর ভবিষ্যতেও কোন সমস্যার সৃষ্টি হলে যেনো তার সমাধান অথবা দিক নির্দেশনা চুক্তিপত্রে উল্ল্যেখ থাকে। চুক্তিপত্রে যে বিষয়গুলো থাকা অবশ্যই উচিৎ সেগুলো হলো:
• পার্টনারশিপ ব্যবসার নাম
• পার্টনারশিপ ব্যবসার ঠিকানা,
• ব্যবসার প্রকৃতি, উদ্দেশ্য ও আওতা,
• ব্যবসার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কাজের এলাকাভিত্তিক পরিধি,
• ব্যবসার মেয়াদকাল
• পার্টনারদের নাম, ঠিকানা ও পেশা
• ব্যবসার মূলধনের পরিমাণ ও প্রকৃতি
• পার্টনারদের প্রদত্ত মূলধনের পরিমাণ ও নতুন মূলধন সংগ্রহের বিষয়ক পরিকল্পনা
• মূলধনের উপর সুদ দেওয়া হবে কিনা, হলে সেটি কত পারসেন্ট হারে
• পার্টনারশিপ ব্যবসার থেকে অংশীদারগণ কোন টাকা তুলতে পারবে কিনা, পারলে তার পরিমাণ এবং কি হারে? টাকা উত্তোলনের উপর সুদ বা মুনাফা ধার্য হবে কিনা, এবং তা কতো হারে
• পার্টনারশিপ ব্যবসার পার্টনারদের মধ্যে লাভ- ক্ষতি বণ্টন পদ্ধতি ও হার
• পার্টনারশিপ ব্যবসা পরিচালনার ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নিয়ম
• ব্যবসার হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ক নিয়মাবলীসহ হিসাবের বই সংরক্ষণ ও পরিদর্শন
• পার্টনারশিপ ব্যবসা টাকা কোন ব্যাংকে রাখা হবে সেই বিস্তারিতসহ ব্যাংকিং কার্যক্রম যিনি পরিচালনা করবেন তার নাম ও পদবি
• বিভিন্ন প্রয়োজনে পার্টনারশিপ ব্যবসার দলিল পত্রে ক্ষমতাপ্রাপ্ত স্বাক্ষর প্রদানকারী পার্টনারের নাম ও পদবি
• পার্টনারশিপ ব্যবসার প্রয়োজনে ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া
• পার্টনারদের অধিকার এবং দায়িত্বসমূহ
• পার্টনারদের মধ্যে কেউ কোন কাজের বিনিময়ে এককালীন বা নিয়মিত পারিশ্রমিক পাবে কিনা সেই বিস্তারিত
• পার্টনারদের সংযোজন- বিয়োজন প্রক্রিয়ার বিস্তারিত
• প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বছরের শুরু এবং শেষ কবে ধার্য করা হবে
• ব্র্যান্ড ভ্যালু তথা সুনাম মূল্যায়নের বিধান
• একজন পার্টনার অবসর নিলে বা মৃত্যুবরণ করলে তার পাওনা পরিশোধসহ তার প্রতি অংশীদারি কারবারের দায় দায়িত্ব
• পার্টনারশিপ চুক্তির কোন পরিবর্তন আনতে হলে, তার প্রক্রিয়া
• পার্টনারশিপ চুক্তিতে উল্লেখ নেই, এমন কোন বিষয় নিয়ে বিরোধ হলে তার মীমাংসা পদ্ধতি
• পার্টনারশিপ ব্যবসা বা অংশীদারি ব্যবসায়ের অবসান তথা বিলুপ্ত হওয়ার পদ্ধতি এবং বিলুপ্তির সময় ব্যবসায়ের সম্পত্তির মূল্যায়ন ও বণ্টন পদ্ধতি।
পার্টনারশিপ ব্যবসাতে কাদের পার্টনার করা যাবেনা?
নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের পার্টনারশিপ ব্যবসাতে পার্টনার করা যাবেনা?
১. নাবালক
২. পাগল
৩. দেউলিয়া ব্যক্তি
৪. অজ্ঞান ব্যক্তি
৫. সরকারি কর্মচারি
৬. রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকা ব্যাক্তি যেমনঃ মন্ত্রিবর্গ বা ব্রাষ্ট্রপতি
৭. প্রতিষ্ঠান বা সংঘ
৮. মানসিক প্রতিবন্ধী
৯. বিদেশি রাষ্ট্রদূত
১০. বিদেশি শত্রু ও দেশদ্রোহী
সম্পর্কিত পোস্ট- ফার্মেসী ব্যবসা।
পার্টনারশিপ ব্যবসাতে কি কি কাগজপত্র লাগবে?
পার্টনারশিপ ফার্ম নিবন্ধন করা হয় নিচের তিনটি সহজ ধাপে এবং এই সম্পর্কিত কাগজগুলোই মূলত প্রয়োজন হয়।
১. পার্টনারশিপ ডিড/ অংশীদারী চুক্তিপত্র করুন
২. আর.জে.এস.সি রেজিষ্ট্রেশন
৩. ট্রেড লাইসেন্স
পার্টনারশিপ ব্যবসা এর ক্ষেত্রে চুক্তিপত্রই সবচেয়ে জরুরি যা নিবন্ধন করা উচিত। সাধারণত এই চুক্তি হয় দুই হাজার টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে। এরপর রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ থেকে চুক্তি নিবন্ধন করাতে হয়। এবং শুধুমাত্র এই নিবন্ধন করা থাকলেই, চুক্তির শর্ত কোনো পার্টনার অমান্য করলে ক্ষতিপূরণসহ অন্যান্য প্রতিকারের জন্য আদালতে গিয়ে আইনি সহায়তা পাবার সুযোগ থাকে।
পার্টনারশিপ ব্যবসায়ের নিবন্ধনের জন্য সরকার নিযুক্ত নিবন্ধকের অফিসে দরখাস্থ জমা দিতে হয়। সাধারণ ও ব্যাংকিং অংশীদারি ব্যবসায়ের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক না হলেও সীমিত অংশীদারি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। আর একটি দেশে ব্যবসায় করতে চাইলে ট্রেড লাইসেন্স তো অত্যাবশ্যকীয় জিনিস যা শুধু পার্টনারশিপ নয়, অন্যান্য ব্যবসার জন্যও প্রয়োজন।
পার্টনারশিপ ব্যবসাতে লাভবান হতে গেলে কি কি করতে হবে?
প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে ব্যবসা কোনো আবেগ বা সম্পর্কের জায়গা নয় তাই হতে হবে কমার্শিয়াল।
- ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে পার্টনার নেয়া ঠিক না। এটি ধীরে ধীরে নানা সমস্যা সৃষ্টি করে এবং তেমন কোনো উল্লেখ্যযোগ্য লাভ দেয় না যা একাধিক অংশীদারকে খুশি করবে।
- দেখতে হবে আপনার ব্যবসায়ীক পার্টনার কি ওয়ার্কিং পার্টনার নাকি ফিন্যান্সিয়াল পার্টনার হতে যাচ্ছে এবং তার সেই ধরণ আপনার ব্যবসার লাভ অর্জনের পথে সহায়ক কিনা।
- পার্টনার ব্যবসায়ী হিসেবে কতোটা মানসিকভাবে শক্তিশালী। যেকোনো ব্যবসা ব্রেক ইভেন্টে পৌঁছাতে দুই থেকে তিন বছর সময় নেয়। এমনকি পাঁচ বছরও লাগতে পারে। অনেক সময় শুরু করার পর পরিকল্পনার অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগেরও প্রয়োজন পড়ে। এ সময় ধৈর্য্য আর সঠিক সিদ্ধান্ত জরুরী। তাই একজন মানসিকভাবে শক্ত ও চৌকশ পার্টনার সফল হবার সম্ভাবনা বাড়ায়।
- পার্টনারশিপ ব্যবসায় শুরুর আগে SWOT Analysis মানে ব্যবসায় প্রত্যেক অংশীদারের শক্তি (S=Strength), দুর্বলতা (W= Weakness), সুযোগ (O= Opportunity) এবং হুমকি (T= Threat) সম্পর্কে জানা ও সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করা পার্টনারশিপ ব্যবসায়কে লাভের মুখ দেখতে সাহায্য করে।
পার্টনারশিপ ব্যবসায় আমাদের দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ব্যবসায় ধরণ। এবং সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা থাকলে এই ব্যবসায়ের মাধ্যমে একইসাথে একাধিক ব্যক্তি ব্যবসায়িক সফলতা লাভ করতে পারেন ।