সফল হতে শেয়ার ব্যবসায়ের কিছু কার্যকরী কৌশল

শেয়ার ব্যবসার কৌশল

সবসময়ই শেয়ার বাজার নিয়ে জনগণের মনে নানারকম ভাবনা আছে। যার কিছু ইতিবাচক, কিছু নেতিবাচক। কিছু আবার প্রশ্নবিদ্ধ। লাভের কথা চিন্তা করেই সবাই শেয়ার ব্যবসায় (share business) জড়িত হবার কথা ভাবলেও, এখনকার প্রেক্ষাপটে লোকসান হবার নানা নজির দেখে অনেকেই পিছপা হয়ে যান। কিন্তু আসল কথা হল শেয়ার ব্যবসায় অন্যান্য সব ব্যবসার মতোই লাভ কিংবা লোকসান- দুইই দিতে পারে। তবে শেয়ার ব্যবসার কৌশল অনুসরণ করলে এ ব্যবসায়ে লাভ করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

Advertisement

সেই ইতিবাচক ভাবনা থেকেই আজ আমরা আলোচনা করব কিছু কার্যকরী শেয়ার ব্যবসার কৌশল (share business strategy) যা এ শেয়ার ব্যবসায়ে আপনাকে সফল হতে সাহায্য করবে। প্রথমে ব্যক্তি পর্যায়ের করণীয় থেকে একে একে ব্যবসায়ীক ডিসিশন ভিত্তিক বিষয়গুলোর দিকে আগানো যাক।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে আপনি কি করতে পারেন?

শেয়ার  ব্যবসায়ে  সফল হওয়ার প্রথম ধাপ নির্ভর করে একজন বিনিয়োগকারীর নিজস্ব কিছু অভ্যাস গঠনের উপর। লোকমুখে নেতিবাচক কিছু শুনলেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। এটি শেয়ার ব্যবসার কৌশল হিসেবে অন্যতম। যেকোনো এনালাইসিস করার সময় ফেস ভ্যালুর  কথা ভুলে অন্যান্য কিছু দিকে লক্ষ্য কুরতে হবে যা পরবর্তীতে আলোচনা করা হয়েছে। শেয়ার মার্কেট এ খুব কম দেশেই এই ফেস ভ্যালুর ধারনা প্রচলিত। বরং প্রতিটি শেয়ারের ইউনিট হিসাব করা হয়।

শেয়ার কেনা বা বিক্রিতে কি কি বিষয় মাথা রাখা দরকার?

নিম্নে উল্লিখিত বিষয়গুলো শেয়ার ক্রয় কিংবা বিক্রি করার সময় মাথায় থাকলে শেয়ার ব্যবসায়ে আপনার সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

  • মাত্রাতিরিক্ত ঊর্ধ্বমুখী বাজারে কখনোই শেয়ার কিনবেন না।
  • একইভাবে সবচাইতে কমদামে শেয়ার কিনবেন, এই পরিকল্পনা ও থাকা যাবেনা।
  • ধার করা বা ঋণ করা অর্থ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করবেন না।
  • হুজুগের বশে, অন্যদের ক্রয় দেখে আবেগের বশে হুট করে কোন শেয়ার কিনবেন না। মাথায় রাখতে হবে শেয়ার বাজারে সবাই যখন বিক্রি করছে, তখন হল কিনার সময়। আবার সবাই জখন হুমড়ি খেয়ে কিনছে, তখন হল বিক্রির সময়।
  • মার্কেট এ শেয়ার এর দাম সবচাইতে বেশী দামে বিক্রি এর জন্য বসে থাকা যাবেনা। আপনার অবশ্যই একটা প্রফিট টার্গেট থাকবে। সেই দামে গেলেই বিক্রি করে দেয়া উত্তম।
  • শেয়ার কেনার আগেই মাইন্ডসেট ঠিক করতে হবে যে শেয়ারটিতে আপনি স্বল্প মেয়াদ, মধ্যম মেয়াদ না দীর্ঘ মেয়াদের জন্য বিনিয়োগ করেছেন।
  • অনেকেই আছেন নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির শেয়ারে কেনা বেচা করেন এবং কম বেশী লাভ ও করে থাকেন। এই ধরনের পরিকল্পনা বিপদজনক। কারণ একটি কোম্পানির ব্যবসা সবসময় লাভজনক না ও হতে পারে। এমনকি উক্ত কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুকিতেও থাকতে পারে।
  • এক সেক্টর এর শেয়ার ব্যবসার কৌশল আরেক সেক্টরে কাজে লাগবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। এটা মাথায় রাখতে হবে।

শেয়ার ব্যবসার কৌশল হিসেবে উপরোক্ত বিষয়গুলো যদি অনুসরন করতে পারেন তাহলে এ ব্যবসায়ে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

Advertisement

PE রেশিও এবং NAV বিবেচনা করা জরুরি

মনে রাখবেন, মূল্য আয় অনুপাত (P/E) ২০ এর কম হওয়া ভালো। পিই রেশিও কম হলে বিনিয়োগের ঝুঁকিও একইসাথে কমে আসে। সহজ করে বললে, কোম্পানির শেয়ার তার আয়ের কতগুণ দামে বিক্রিত হচ্ছে তার পরিমাপই হলো মূল্য-আয় অনুপাত। শেয়ার ব্যবসার কৌশল হিসেবে PE Ratio জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ধরা যাক, একটি কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় ২০ টাকা এবং বাজারে শেয়ারটির দাম ২০০ টাকা, সেই হিসেবে মূল্য-আয় অনুপাত ১০। এখন কোম্পানি যদি আয়ের সবটুকু লভ্যাংশ হিসেবে দিয়ে দেয় তাহলে বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত আসতে ১০ বছর সময় লাগবে। কিন্তু শেয়ারটির বাজার মূল্য যদি হতো ৬০০ টাকা, তাহলে মূল্য-আয় অনুপাত বা পিই রেশিও হয়ে যেত ৩০। অর্থাৎ কোম্পানির আয়ের ধারা একই থাকলে বিনিয়োগ ফিরতে ৩০ বছর সময় প্রয়োজন।

আবার প্রতি সম্পদ মূল্য (NAV) এর সাথে বাজারমূল্যের একটা সামঞ্জস্য থাকা খুবই প্রয়োজন। যদিও এক্ষেত্রে অনেকে বলে থাকেন যে, কোম্পানির বিলুপ্তি) না হলে সম্পদ মূল্যের কারণে বিনিয়োগকারীর উপর কোনো প্রভাব নেই। তবু এটি খেয়াল রাখা প্রয়োজন কারন কোম্পানির বিলুপ্তি হলে শেয়ারহোল্ডাররা সম্পদের একটি অংশ পান। এবং এই সম্পদ বিক্রির মূল্য থেকে ব্যাংক ঋণ এবং অন্যান্য যা পাওনা আছে তা পরিশোধ করা হয়ে থাকে। এরপর যা অবশিষ্ট থাকে তা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে ভাগ করা হয়।

আরও পড়ুন- শেয়ার বাজারের বর্তমান অবস্থা

EPS এবং মোট শেয়ার এর পরিমাণ মাথায় রাখতে হবে

প্রতি শেয়ারে কত আয় (EPS) তা দেখে ভালো শেয়ার চেনা যায়। কারণ EPS যত বেশি হবে তত ভালো বা নিরাপদ। ইপিএস বেশি হলেই কিন্তু বেশি লভ্যাংশ দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ইপিএস কম হলে লভ্যাংশের সক্ষমতাও স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। তাই শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে লাভের আশায় এই বিষয়টি অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।

Advertisement

অন্যদিকে মোট শেয়ারের সংখ্যা কত আর তার ভেতর ফ্লোটিং কতটুকু তা কিন্তু শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই বটে। কারন চাহিদা-যোগানের চিরকালীন নিয়মে, শেয়ার সংখ্যা কম হলে তার মূল্য বাড়ার সুযোগ বেশি। আবার শেয়ার সংখ্যা বেশি হলে স্বাভাবিকভাবেই বাজারে তা অনেক বেশি সহজলভ্য হয়ে দাম কমে যায়।

আবার নিয়মিত ভালো পরিমাণ লেনদেন হয় এধরনের শেয়ার বেছে কেনা নিরাপদ। কারণ প্রয়োজন হলে সহজেই শেয়ার বিক্রি করে টাকা বাজার থেকে তুলে নেয়া যায়। অন্যদিকে নিয়মিত লেনদেন না হওয়া শেয়ারগুলোতে বিনিয়োগ করলে জরুরি ভিত্তিতে বিনিয়োগ সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয় না।

শেয়ার ব্যবসার কৌশল হিসেবে EPS এবং মোট শেয়ার এর সংখ্যা, পাবলিক, ইন্সটিটিউট বা ফরেন বিনিয়োগকারিদের হাতে থাকা শেয়ার সংখ্যা এনালাইসিস করে শেয়ার এ বিনিয়োগ করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অনুমোদিত মূলধন (Authorized Capital), পরিশোধিত মূলধন (Paid capital) রেশিও এবং Dividend End

লাভজনক ও নিরাপদ শেয়ার কেনার উদ্দেশ্য থাকলে অবশ্যই অনুমোদিত মূলধন আর পরিশোধিত মূলধন রেশিও দেখে কেনা জরুরি। দুই মূলধনের পরিমাণ কাছাকাছি হলে বোনাস ও রাইট শেয়ার ইস্যু করা বেশ কঠিন হয়ে। এক্ষেত্রে কোম্পানিকে আগে অনুমোদিত মূলধন বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। বোনাস লভ্যাংশে আগ্রহী বিনিয়োগকারী হয়ে থাকলে এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। 

অন্যদিকে, শেয়ারের বাজার মূল্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিহিত মূল্যের চেয়ে বেশি হয়। তাই লভ্যাংশের হার প্রকৃত রিটার্ন নির্দেশ করবে এমন কোনো চিরসত্য নেই।

ডিভিডেন্ড ইল্ডই হলো শেয়ারের আসল রিটার্ন। বাজার মূল্যের ভিত্তিতে প্রাপ্য লভ্যাংশ বিনিয়োগের কত শতাংশ হচ্ছে তাকে বলে ডিভিডেন্ড ইল্ড। ঘোষিত লভ্যাংশকে ১০০ দিয়ে গুণ করে, এরপর সংশ্লিষ্ট শেয়ারের বাজার মূল্য দিয়ে ভাগ করলে ডিভিডেন্ড ইল্ড বেড় হয়ে আসে। ডিভিডেন্ড ইল্ড যত বেশি হয়, বিনিয়োগকারীর প্রাপ্তিও তত বেশি হবার সুযোগ থাকে। শেয়ারে নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে না ভাবার কোনো অবকাশ নেই। এটি শেয়ার ব্যবসার কৌশল হিসেবে অন্যতম যদি আপনি শেয়ার ব্যবসায়ে সফল হতে চান।

সঠিক এবং বিস্তারিত গবেষণা

রিসার্চ শেয়ার ব্যবসার কৌশল এর মধ্যে অন্যতম। কোম্পানির অতীত রেকর্ড, ডিভিডেন্ড, বার্ষিক গড় মূল্য দেখে তার কাছাকাছি  মূল্যে শেয়ার কিনতে হবে।

এরপর ডিএসইর সাইটে প্রকাশিত গত ৫-৬ মাসের খবর দেখা, পত্রিকা ও টেলিভিশনের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ার সহায়তায় দেশ-বিদেশের অর্থনীতি ও ব্যবসার সংবাদগুলোতে নজর রাখা দরকার। এভাবে সম্ভাবনাময় খাত ও কোম্পানি সহজেই আলাদা করে নিরাপদে ও লাভজনকভাবে বিনিয়োগ করার দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যায়।

তাছাড়া, ডিএসই বর্তমানে ৪ মাস পর পর কোম্পানির আর্নিং রিপোর্ট প্রকাশ করে যা দেখে এবং কিছু ক্যালকুলেশন করে  বছর শেষে কী পরিমাণ লাভ হতে পারে তার একটা খসড়া হিসাব করা যায়। শেয়ার ব্যবসায়ে সফল হতে চাইলে অন্য সব বিষয় এর সাথে এই বিষয় এ ও নজর রাখা দরকার।

কোম্পানি পরিচালকদের ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, পেশাদারিত্ব এবং সামাজিক অবস্থান বিশ্লেষণ

সফলতার জন্য শেয়ার ব্যবসার কৌশল হিসেবে কোম্পানি পরিচালকদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ এবং তথ্য বিশ্লেষণ অন্যতম কার্যকর একটি বিষয়। এ কাজটি অধিকাংশ বিনিয়োগকারী ই করেন না, গুরুত্ব দেননা বা তথ্য জানার কোন সোর্স থাকেনা বিধায় অতটা আগ্রহ দেখান না।

যেকোন কোম্পানির শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে সে কোম্পানির সুনাম, সাথে পরিচালকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় ও অবস্থান খেয়াল করা দরকার। কোম্পানির সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে এর উদ্যোক্তাদের দূরদর্শীতা ও দক্ষতার উপর। একইসাথে শেয়ার হোল্ডারদের প্রতি কোম্পানি কতোটা আন্তরিক তারও প্রভাব আছে ।

পরিচালকেরা মুনাফার সবটাই হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করে নাকি  লভ্যাংশের ব্যাপারে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল ব্যবহার  করে কিংবা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ তারা বিবেচনায় রাখে কিনা সেটি শেয়ার ব্যবসায়ে সফল হতে এবং আপনার বিনিয়োগ নিরাপদ রাখার জন্য খুবই জরুরি।

Advertisement

Similar Posts

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।