শেয়ার বাজার এ নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগের ৫টি কার্যকর টিপস

শেয়ার মার্কেট এর বর্তমান অবস্থা

শেয়ার বাজার নিয়ে সাধারন বিনিয়োগকারী এবং সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী ও জনগণের মনে নানান চিন্তা ও প্রশ্ন থাকে। লাভের কথা চিন্তা করে অনেকেই শেয়ার ব্যবসায় জড়িত হবার কথা ভাবলেও, শেয়ার বাজারের বর্তমান অবস্থা, দীর্ঘদিন ধরে ষ্টক মার্কেট চালু থাকলেও এই মার্কেটটি শক্তিশালী না হতে পারা এবং বিভিন্ন সময়ে শেয়ার কেলেঙ্কারি সহ অন্যান্য অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কথা ভেবে পিছপা হয়ে যান।

তবে এত কিছুর পরও শেয়ার ব্যবসা অন্যান্য সব ব্যবসার মতোই লাভ কিংবা লোকসান- দুইই দিতে পারে। বরঞ্চ নিয়ম মেনে অতিরিক্ত ঝুকি ও লোভ পরিহার করে শেয়ার ব্যবসা করলে এই ব্যবসায়ে লাভের মার্জিন অন্য যেকোন ব্যবসার চাইতে বেশি। এটা খুবই স্বাভাবিক যে একজন বিনিয়োগকারী হিসাবে যে কেউ লাভের আশায় ব্যবসা করে থাকেন৷ আজ আমরা আলোচনা করব নিরাপদ ও লাভজনকভাবে শেয়ার ব্যবসায় করতে হলে কোন পাঁচটি টিপস আপনার জন্য কার্যকর হবে।

শেয়ার মার্কেট এ লাভজনক বিনিয়োগের ৫টি টিপস

শেয়ার বাজারের বর্তমান অবস্থা যাই থাকুক না কেন, ৫টি টিপস অনুসরণ করে শেয়ার মার্কেট এ আপনার বিনিয়োগ নিরাপদ রেখে লাভবান হতে পারবেন আশা করি।

  • শেয়ারের মূল্য আয় অনুপাত (P/E), প্রতি সম্পদ মূল্য (NAV) এবং RSI (Relative strength index) ইনডেকিটর খেয়াল করুন।
  • শেয়ার প্রতি আয় (EPS) ও মোট শেয়ারের সংখ্যা দেখুন।
  • অনুমোদিত মূলধন ও পরিশোধিত মূলধন রেশি ও  ডিভিডেন্ড ইল্ড।
  • যে কোম্পানির শেয়ার কিনবেন সেটি নিয়ে সঠিক রিসার্চ করুন। বোনাস শেয়ার, রাইট শেয়ার, নগদ লভ্যাংশ, ইপিএস, এনওসিপিএস, অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন, স্বল্প মূলধনী কোম্পানি ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন।
  • ব্যক্তিগত কিছু অভ্যাস গঠন।

শেয়ারের মূল্য আয় অনুপাত (P/E), প্রতি সম্পদ মূল্য (NAV) এবং RSI (Relative strength index) ইনডেকিটর খেয়াল করুন

মূল্য আয় অনুপাত (P/E) ২০ এর কম হওয়া উচিৎ। পিই রেশিও কম হলে বিনিয়োগে ঝুঁকি কমে আসে। একটি কোম্পানির শেয়ার তার আয়ের কতগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে তার একটি পরিমাপই হলো মূল্য-আয় অনুপাত।

ধরা যাক, একটি কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় ২০ টাকা এবং বাজারে শেয়ারটির দাম ২০০ টাকা, সেই হিসেবে মূল্য-আয় অনুপাত ১০। তাহলে কোম্পানিটি যদি তার আয়ের পুরোটা লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করে দেয় তাহলে বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পেতে ১০ বছর সময় লাগবে। কিন্তু শেয়ারটির বাজার মূল্য যদি হতো ৪০০ টাকা, তাহলে মূল্য-আয় অনুপাত বা পিই রেশিও দাঁড়াতো ২০। অর্থাৎ কোম্পানির আয়ের ধারা অপরিবর্তিত থাকলে বিনিয়োগ ফেরতে ২০ বছর সময় প্রয়োজন।

আবার প্রতি সম্পদ মূল্য (NAV) এর সাথে বাজারমূল্যের একটা সামঞ্জস্য থাকা খুবই প্রয়োজন। যদিও এক্ষেত্রে অনেকে বলে থাকেন যে, কোম্পানির বিলুপ্তি) না হলে সম্পদ মূল্যের কারণে বিনিয়োগকারীর উপর কোনো প্রভাব নেই। তবু এটি খেয়াল রাখা প্রয়োজন কারন কোম্পানির বিলুপ্তি হলে শেয়ারহোল্ডাররা সম্পদের একটি অংশ পান। এবং এই সম্পদ বিক্রির মূল্য থেকে ব্যাংক ঋণ এবং অন্যান্য যা পাওনা আছে তা পরিশোধ করা হয়ে থাকে। এরপর যা অবশিষ্ট থাকে তা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে ভাগ করা হয়। তাই বিনিয়োগের নিরাপত্তা বিবেচনায় ন্যাভ এর বিষয়টি ও মাথায় রাখা জরুরী।

যেকোন শেয়ার এ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আর একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ইনডিকেটর হল RSI. সাধারনত টেকনিকাল এনালিস্টরা এই RSI ইনডিকেটরকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। RSI ইনডিকেটর দিয়ে একটি শেয়ার বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ বা ঝুকিপূর্ণ এটা বের করা হয়। সাধারণত কোন নির্দিষ্ট শেয়ার এর RSI ২০ এর আশেপাশে থাকলে সেটি বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ এবং RSI ৮০ এর কাছাকাছি বা উপরে থাকলে সেটা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

তবে এটি সবসময় কাজ করবে এমন নয়, বিশেষ করে যদি নির্দিষ্ট কোন কোম্পানির শেয়ার এর মুল্য সংবেদনশীল কোন ইনফরমেশন বা সংবাদ থাকে। তবে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে শেয়ার মার্কেট এ RSI ইনডিকেটর বিবেচনায় নেয়া খুবই কার্যকর একটি পন্থা।

সংশ্লিষ্ট পোস্ট- শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ

শেয়ার প্রতি আয় (EPS) ও মোট শেয়ারের সংখ্যা দেখুন

শেয়ার প্রতি আয় (EPS) যত বেশি হবে ততই ভালো। ইপিএস বেশি মানে বেশি লভ্যাংশ দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ইপিএস কম হলে লভ্যাংশের সক্ষমতাও কমে যায়। তাই শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।

অন্যদিকে মোট শেয়ারের সংখ্যা আর তার কতটুকু ফ্লোটিং তা কিন্তু শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারন চাহিদা-যোগানের চিরচেনা নিয়ম ভাবলে, শেয়ার সংখ্যা কম হলে তার মূল্য বাড়ার সুযোগ বেশি। আবার শেয়ার সংখ্যা বেশি হলে স্বাভাবিকভাবেই বাজারে তা অনেক বেশি সহজলভ্য হয়ে যায়, প্রাইস মুভমেন্ট এ অনেক বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়, আর কমে যায় দাম বাড়ার সুযোগ।

আবার নিয়মিত ভালো অঙ্কের লেনদেন হয় এধরনের শেয়ার বেছে কেনা ভালো। কারণ জরুরী প্রয়োজন হলে সহজেই শেয়ার বিক্রি করে টাকা বাজার থেকে বের করে নেয়া সম্ভব। অন্যদিকে নিয়মিত লেনদেন হয় না যেসব শেয়ার সেগুলোতে বিনিয়োগ করা হলে জরুরি ভিত্তিতে বিনিয়োগ সরিয়ে ফেলার সুযোগ নেই।

অনুমোদিত মূলধন ও পরিশোধিত মূলধন রেশিও এবং ডিভিডেন্ড ইল্ড

শেয়ার কেনার সময় অবশ্যই অনুমোদিত মূলধন আর পরিশোধিত মূলধন রেশিও দেখে নিন। দুই মূলধনের পরিমাণ কাছাকাছি হলে বোনাস ও রাইট শেয়ার ইস্যু করা বেশ কঠিন হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কোম্পানিকে আগে অনুমোদিত মূলধন বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। বোনাস লভ্যাংশে আগ্রহী বিনিয়োগকারী হয়ে থাকলে এই বিষয়টি মাথায় রাখতেই হবে। অন্যদিকে, শেয়ারের বাজার মূল্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিহিত মূল্যের চেয়ে বেশি হয়ে । তাই লভ্যাংশের হার প্রকৃত রিটার্ন নির্দেশ করবে এমন কোনো কথা নেই।

ডিভিডেন্ড ইল্ডই হলো শেয়ারের আসল রিটার্ন। বাজার মূল্যের ভিত্তিতে প্রাপ্য লভ্যাংশ বিনিয়োগের কত শতাংশ হচ্ছে তাকে বলে ডিভিডেন্ড ইল্ড। ঘোষিত লভ্যাংশকে ১০০ দিয়ে গুণ করে, এরপর সংশ্লিষ্ট শেয়ারের বাজার মূল্য দিয়ে ভাগ করলে ডিভিডেন্ড ইল্ড বেড় হয়ে আসে। ডিভিডেন্ড ইল্ড যত বেশি হয়, বিনিয়োগকারীর প্রাপ্তিও তত বেশি হবার সুযোগ থাকে। শেয়ারে নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে না ভাবার কোনো অবকাশ নেই।

আরও পড়ুন- শেয়ার ব্যবসা কি এবং শেয়ার ব্যবসায় লাভবান হওয়ার টিপস

যে কোম্পানির শেয়ার কিনবেন সেটি নিয়ে সঠিক রিসার্চ করুন

শেয়ার বাজারের বর্তমান অবস্থা যেটাই হোক, যেকোন অবস্থায় বিনিয়োগের জন্য সম্ভাব্য শেয়ার নিয়ে পর্যাপ্ত এনালাইসিস করা দরকার। রিসার্চ করার জন্য নিচের টিপস অনুসরণ করতে পারেন।

নিরাপদে বিনিয়োগ করতে একটি কোম্পানির  গত ৩-৪ বছরের ট্র্যাক রেকর্ড দেখা উচিৎ। ডিভিডেন্ড দেবার পরিমাণ,  বার্ষিক গড় মূল্য ইত্যাদি দেখে তার কাছাকাছি  মূল্যের শেয়ার কেনার চেষ্টা করা ভালো। এছাড়া, ডিএসইর সাইটে প্রকাশিত গত ৫-৬ মাসের খবর দেখা, পত্রিকা ও টেলিভিশনের পাশাপাশি বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সহজেই দেশ-বিদেশের অর্থনীতি ও ব্যবসার সংবাদগুলোতে নজর রাখা সম্ভব। এতে করে সম্ভাবনাময় খাত ও কোম্পানি সহজেই নজরে রেখে নিরাপদে ও লাভজনকভাবে বিনিয়োগ করা যায়।

এর বাইরে, ডিএসই বর্তমানে ৪ মাস পর পর কোম্পানির আর্নিং রিপোর্ট প্রকাশ করে যা দেখে এবং কিছু ক্যালকুলেশন করে  বছর শেষে কী পরিমাণ লাভ হতে পারে তা হিসাব করা যায়।

আরেকটি জরুরি ব্যাপার হলো,  একটি কোম্পানির শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে সে কোম্পানির সুনাম, তার পরিচালকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় ও অবস্থান বিবেচনা করা দরকার। একটি কোম্পানি কতোটা ভালো ব্যবসা করবে, ব্যবসা বৃদ্ধির  সম্ভাবনা কেমন তা নির্ভর করে এর উদ্যোক্তাদের দূরদর্শীতা ও দক্ষতার সাথে সাথে শেয়ার হোল্ডারদের প্রতি কতোটা আন্তরিক তার উপর। তারা মুনাফার সবটাই হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করবে কিনা বা লভ্যাংশের ব্যাপারে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল ব্যবহার  করে, না-কি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ তারা বিবেচনায় রাখে- এসব একটি নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগের জন্য খুবই জরুরি আলাপ।

ব্যক্তিগত কিছু অভ্যাস গঠন

শেয়ার বাজার এমন এক জায়গা যেখানে আপনি যেমন দ্রুত লাভবান হতে পারবেন ততটাই দ্রুত বিশাল লসের ও মুখোমুখি হতে পারেন। এই মার্কেট এ টিকে থেকে লাভবান হতে চাইলে, সেই লাভটা ধরে রাখতে চাইলে আপনাকে প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে যাতে আপনি লস না করেন এবং করলেও যাতে সেটা আপনার লাভের চাইতে কম হয়।

এসব করতে হলে আপনাকে আপনার ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা, অভ্যাস ইত্যাদিতে একটা পজিটিভ পরিবর্তন আনতে হবে। তাই ৫টি কার্যকর টিপস এর একটি হিসেবে ব্যক্তিগত অভ্যাস এর উপর নিয়ন্ত্রন আনা জরুরী। এরকম কিছু বিষয়ে নিম্নে আলকপাত করা হল।

  • প্রথমত, শেয়ার বাজারের বর্তমান অবস্থা যা-ই হোক, আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। যেকোনো এনালাইসিস করার সময় ফেস ভ্যালুর  কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া আর কোথাও ফেস ভ্যালুর এ ধারনার প্রচলিত নয়। বরং প্রতিটি শেয়ারের ইউনিট হিসাব করা হয়।
  • চাঙ্গা মার্কেটে মাত্রাতিরিক্ত মূল্যে শেয়ার ক্রয় করা বোকামি। আর অবশ্যই সর্বনিম্ম দামে শেয়ার ক্রয় বা সর্বোচ্চ দরে শেয়ার বিক্রয়ের মনোভাব থাকলে তা ত্যাগ করা প্রয়োজন।
  • চেষ্টা করতে হবে কখনোই ঋণ করে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ না করতে। 
  • সবাই যেই শেয়ারের পিছনে ছুটছে তার পিছনে নিজেও ছুট দেয়া যাবে না। বরং নিজের কাছে ঐ শেয়ার থাকলে তা বিক্রির মোক্ষম সময় এটি।
  • একটি শেয়ার একবার বা একাধিকবার কিনে লাভ হলে তা সারাজীবনই লাভজনক থাকবে এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসা দরকার।
  • সব পরিস্থিতিতে একই কৌশল খাটানোর চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। চাঙ্গা বাজারের কৌশল মন্দা বাজারের জন্য নয়। গার্মেন্টস সেক্টরের কৌশল আবার  হেলথ সেক্টরে চলে না।
  • বিনিয়োগ করেই লাভ এর আশা না করে সময় দিন, বিক্রয় এর সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করুন।
  • শেয়ার বাজার একটি স্পর্শকাতর জায়গা যা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক বিষয় বা ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রতিকুল পরিস্থিতি তে খুব ভালো শেয়ার ও বিশাল লসে চলে যেতে পারে। এরকম পরিস্থিতি পরিহার করার জন্য যে শেয়ার কিনবেন তার জন্য একটি স্টপ লস পয়েন্ট সেট করুন যেটি অতিক্রম করলে ওই শেয়ারটি থেকে স্টপ লস দিয়ে বের হয়ে যেতে হবে এমন মানসিক প্রস্তুতি রাখুন। মনে রাখতে হবে আপনার পুঁজি থাকলে আর একটি শেয়ার এ বিনিয়োগ করে যে স্টপ লসটি দিলেন সেটা রিকভারি করার সুযোগ পাবেন।

শেষকথা

স্থিরভাবে রিসার্চ করুন, সবদিক বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগ করুন, ধীরে সুস্থে চিন্তাভাবনা করে পদক্ষেপ নিন এবং নিশ্চিত করুন আপনার শেয়ার  ব্যবসায়ে  লাভজনক ও নিরাপদ বিনিয়োগ।

Similar Posts

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।