বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে ফ্লোর প্রাইস কেন আরোপ হয়েছিল?
ফ্লোর প্রাইস শব্দটি শুনলেই এর অর্থ অনেকটা পরিষ্কার হয়। একদম নীচে বা তলানিতে যেই মুল্য তাই মুলত ফ্লোর প্রাইস।
মূলত ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন দর সীমা বলতে বাজারের কোনো পণ্যের সর্বনিম্ন বাজারমূল্য বুঝানো হয়, যার নিচে ওই নির্দিষ্ট পণ্য কেনাবেচা করা যায় না। সাধারণতভাবে দেখা যায়, কৃষিপণ্যের অস্বাভাবিক দরপতনের ক্ষেত্রে কৃষককে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে বিভিন্ন দেশের সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই দর বেঁধে দিয়ে অবস্থা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।
কিন্তু গত কয়েক বছরে শেয়ার বাজার বাংলাদেশ এ ও এই বাক্যটি পরিচিত। কারন, বিগত করোনা মহামারির শুরুর দিকে বাংলাদেশের শেয়ার বাজার এ অস্বাভাবিক পতন রোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিটি শেয়ার এর ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দেয়।
শেয়ার বাজারে ফ্লোর প্রাইস আরোপে বাংলাদেশ ই কি প্রথম?
এই প্রশ্নটির উত্তর হচ্ছে না। শেয়ার বাজার বাংলাদেশ এ আরোপিত হওয়ার আগে শেয়ার বাজারে ফ্লোর প্রাইস আরোপের উদাহরণ ছিলো আর একটি। পাকিস্তানে ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার সময় ব্যাপক দরপতন চলাকালীন করাচি স্টক এক্সচেঞ্জ (বর্তমানে পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জ) ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে। তবে এই ফ্লোর প্রাইস আরোপ করার মাত্র দুই মাসের মধ্যে পাকিস্তানের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অব পাকিস্তান তৎকালীন করাচি স্টক এক্সচেঞ্জকে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেবার নির্দেশ দেয়। ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হলে ব্যাপক দরপতন হয় কিন্তু নতুন করে তারা আর ফ্লোর প্রাইস ঠিক করে দেয় নি।
বাংলাদেশে শেয়ার বাজারে ফ্লোর প্রাইস আরোপের বিস্তারিত
শেয়ার বাজার বাংলাদেশ এ গত চার বছরে মোট তিন দফায় সব শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস ঠিক করে দিয়েছে স্বয়ং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। একটানা পতন আটকাতে না পেরে প্রথমবার ২০২০ সালের ১৯ মার্চ ফ্লোর প্রাইস ঠিক করে দেয় সংস্থাটি। যা শেয়ার মার্কেট থেকে আবার সম্পূর্ণরূপে তুলে নেওয়া হয় ২০২১ সালের ১৭ জুলাই।
তারপর আবার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ১ মার্চ সব শেয়ারের দরে নিচের সার্কিট ব্রেকার ২ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেয় সংস্থাটি। যদিও এখানে একটা ব্যাপার হলো যে, যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই কিন্তু দরপতন চলছিল। এই ব্যবস্থা নেবার পরও কোনো কাজ না হওয়ায় একই বছর ২৮ জুলাই দ্বিতীয় দফায় সব শেয়ারের দরে ফ্লোর প্রাইস আরোপিত হয়। দুঃখজনকভাবে এ পর্যায়ে শেয়ার লেনদেন ব্যাপকভাবে কমে যায়।
এই নিয়ে সমালোচনার শুরু হলে ধাপে ধাপে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা থেকে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর ১৬৭ শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হয়। সর্বশেষ ২০২২ এর জানুয়ারি এর মধ্যে ১২ টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস বহাল রেখে পুজিবাজারে তালিকাভুক্ত অবশিষ্ট ৩৩৭টি মিউচুয়াল ফান্ড এবং কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হয়।
কেনো বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে নির্ধারণ করা হয়েছিলো এই ফ্লোর প্রাইস?
বাংলাদেশে করোনা মহামারীর ঢেউ শুরু হলে প্রথম বার যখন বাজার ব্যাপক সংকটের মুখোমুখি হয় তখন বাজার আরও ভয়াবহ পতনের আশংকা থেকে মুক্তি পেতেই BSEC থেকে শেয়ার বাজার বাংলাদেশ এ এই ফ্লোর প্রাইস সেট করা হয়েছিল যা প্রথমে নানা সমালোচনার মুখে পড়লেও পরবর্তীকালে একটি কার্যকরী সিদ্ধান্ত হিসেবে সবার কাছে প্রসংসিত হয়। BSEC এর ইতিহাসে স্বপ্রনোদিত হয়ে শেয়ার মার্কেট কে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার এই বিষটি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার আলো ফীটায় এবং এক নজির সৃষ্টি করে। কারন তখনকার প্রেক্ষাপটে এটি আরোপ করা না হলে দেশের শেয়ার বাজার অনেকটাই ধবংস হয়ে যেত।
আরও পড়ুন- শেয়ার ব্যবসা কি এবং শেয়ার ব্যবসায় লাভবান হওয়ার টিপস।
দেশের শেয়ার বাজার থেকে ফ্লোর প্রাইস কেন তুলে নিতে হয়েছিল?
শেয়ারবাজার বাংলাদেশে প্রথমবার ফ্লোর প্রাইস আরোপ এর কার্যকারিতা থাকলেও ধীরে ধীরে এই এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো সবার সামনে আসতে শুরু করে। ফ্লোর প্রাইসের বিষয়টি উভয় সংকট তৈরী করতে থাকে। GP, Squarepharma, Fortune, Batbc কিংবা Robi এর মতো fundamental শেয়ার দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকে। সামান্য পরিমানে লেনদেন হওয়া এবং ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকাঅধিকাংশ শেয়ার নানান শংকার জন্ম দিতে তাকে। যারাই বিনিয়োগ করছিলেট, অধিকাংশেরই বিনিয়োগ ব্লক হয়ে যাচ্ছিল!
ফ্লোরে ইনভেষ্টমেন্ট করলে ফান্ড আটকে যা্য বলে ফ্লোর প্রাইসের শেয়ার কিনতে কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। আর বড় বিনিয়োগকারী থেকে অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পর্যন্ত ফ্লোর প্রাইস না তুলে আর নতুন ইনভেষ্টমেন্ট করার ঝুঁকি নিচ্ছিলেন না। এমন পরিস্থিতি্তে লেনদেন একবারেই কমে গিয়েছিল, অধিকাংশ শেয়ার ফ্লোরে আটকা পড়েছিল এবং হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ব্লক হয়ে গিয়েছিল।
দেশের শেয়ার বাজার হয়ে উঠেছিল একেবারেই নিস্প্রান যার দরুন নতুন বিনিয়োগকারিরা ও এই বাজারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন।ফলশ্রুতিতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ধাপে ধাপে সিংহভাগ শেয়ার থেকে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়। এতে বাজার সাময়িক ভাবে কিছুটা গতি পায়, লেনদেন ও বাড়ে।
শেষকথা
ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে নেয়ার ফলে শেয়ার বাজার বাংলাদেশ এ লেনদেন এবং লেনদেনে কিছুটা গতি বেড়েছে এটা সত্য। তবে এটাও সত্য এখনো এই বাজার ভারসাম্যপূর্ণ নয় এবং বাজার দীর্ঘমেয়াদে ভালো হতে যাচ্ছে এটা আত্নবিশ্বাস এর সাথে বলা কঠিন। দীর্ঘমেয়াদে একটা ভারসাম্যপূর্ণ শেয়ারবাজার দেখতে চাইলে অবশ্যই নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দক্ষতার সাথে, পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে সম্পূর্ণ পেশাদারিত্বের সাথে বাজার পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রন করতে হবে।