ঢাকা ষ্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজার কিভাবে পরিচালিত হয়?
শেয়ার বাজারের সাথে জড়িত অথবা এর সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা রাখা যে কেউ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজার শব্দটির সাথে পরিচিত। আজকের আলোচনায় আমরা এই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং এর সাথে সম্পর্কিত আরো বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ নিয়ে জানতে হলে প্রথমে আমাদের জানতে হবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নিয়ে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কি?
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন যাকে সংক্ষিপ্তভাবে বিএসইসি বলা হয়, তা হলো মূলত একটি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যা বাংলাদেশের মূলধন বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এর আওতায় রয়েছে দুইটি স্টক এক্সচেঞ্জ। একটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজার এবং অপরটি হলো চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজার।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার মূল্যসমূহের সকল প্রকার গতিপ্রকৃতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা করার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে। বিএসইসি বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা একটি সংগঠন এবং বর্তমানে এর চেয়ারম্যান এর দায়িত্বে রয়েছেন শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৩ সালের ৮ জুন। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন ১৯৯৩ এর ক্ষমতাবলে এর প্রতিষ্ঠা কাজ সম্পন্ন হয়।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজার বা ডিএসই কি?
বাংলাদেশের প্রথম ও প্রধান শেয়ার বাজার হলো ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজার বা ডিএসই । আর দ্বিতীয় শেয়ার বাজারটি হলো চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসই এর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস হলো ১৯৫২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে প্রথম যখন স্টক এক্সচেঞ্জের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ওই সময় এই অঞ্চলের একমাত্র স্টক এক্সচেঞ্জ হিসাবে কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ পাকিস্তানি কোম্পানির ব্যবসার জন্য শেয়ার এবং সিকিউরিটি লেনদেন নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে পাকিস্তানের প্রাদেশিক বাণিজ্য পরামর্শক পরিষদ একটি স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা নির্ধারণ করার দায়িত্ব পায়। অবশেষে ১৯৫৯ সালে বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে, নানা পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় যাত্রা শুরু করে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা সংক্ষেপে ডিএসই নিবন্ধিত হয়েছে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজার পরিচালিত হয় আর্টিকেলস অফ রুলস এন্ড রেগুলেশন্স এন্ড বাই-লজ, সিকিউরিটিজ এবং এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ১৯৬৯, কোম্পানী আইন ১৯৯৪ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এবং এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন ১৯৯৩ দ্বারা । গঠনপ্রনালি অনুযায়ী ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এর পরিচালক সংখ্যা ১৩।
বর্তমানে ঢাকার নিকুঞ্জ এলাকায় ডিএসই-এর প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। বর্তমানে ডিএসইতে মুল লেনদেনে তালিকাভুক্ত ৩৫৬টি কোম্পানির মোট পরিশোধিত মূলধন কমবেশি ৮৭০০০ কোটি টাকা এবং এর বাইরে মুল লেনদেনে তালিকাভুক্ত ৩৬টি মিউচুয়াল ফান্ড এর মূলধন কমবেশি ৫৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ডিএসইতে মুল লেনদেনে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এবং মিউচুয়াল ফান্ড এর পরিশোধিত মূলধন প্রায় ৯২৫০০ কোটি টাকা। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী যার বাজার মূলধন প্রায় ৪ লক্ষ ৫২ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে খাতওয়ারী হিসাব করলে বাজার মূলধনের হিসাবে ওষুধ এবং রসায়ন খাতের বাজার মূলধন সবচেয়ে বেশি, শতাংশের হিসাবে যা প্রায় ১৬ শতাংশ। বাজার মূলধনের হিসাবে ২য় অবস্থানে রয়েছে ব্যাংক খাত যা বর্তমান মোট বাজার মূলধনের প্রায় ১৫ শতাংশ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজার এর কার্যাবলি
গঠন প্রনালি অনুযায়ী ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজার এর প্রধান কার্যাবলী নিম্নে দেয়া হল।
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহের নথিভুক্তিকরণ
যে সকল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান শেয়ার মার্কেটে প্রবেশ করতে চাচ্ছে তাদের সকল প্রকার নথিভুক্তিকরনের কাজ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পরিচালনা করে থাকে।
নথিভূক্ত সিকিউরিটিজের নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য
নথিভুক্ত সিকিউরিটিজ এর বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করা ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এর কাজ। সামগ্রিক শেয়ার বাজারকে স্থির ও সঠিক পথে রাখতে এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বাণিজ্য সমঝোতা
শেয়ার বাজারে যেকোনো ধরনের বাণিজ্য সমঝোতার ক্ষেত্রে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে।
বিনিময় নিয়ন্ত্রণ
কি পরিমান অর্থের বিনিময়ে কি পরিমান শেয়ার আদান-প্রদান হবে এই বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যেকোনো শেয়ার বাজারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই জরুরী কাজটি করে থাকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ।
বাজার পর্যালোচনা
সামগ্রিক শেয়ারবাজার পর্যালোচনা করে সেই মোতাবেক নানান ব্যবস্থা নেওয়া, উদ্যোগ গ্রহণ, ও নীতিমালা প্রণয়নও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এর কাজ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা এবং সেক্টর সমূহ
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজারে মুল লেনদেনে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ৩৫৬ টি এবং তালিকাভুক্ত মিউচুয়াল ফান্ড এর সংখ্যা ৩৬টি।
অর্থনীতির প্রধান ক্ষেত্রগুলোকে মাথায় রেখে গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রি ক্লাসিফিকেশন স্ট্যান্ডার্ড বা জিআইসিএস অনুযায়ী ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজারে মোট সেক্টর ১১ টা হিসাব করা হয়। প্রত্যেকটি সেক্টরের মধ্যে আনুসাঙ্গিক ইন্ডাস্ট্রি এবং সাব-ইন্ডাস্ট্রি আলাদা করে তার আওতায় বিভিন্ন কোম্পানিগুলোকে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।
আর্থিক ক্ষেত্র বা ফিনান্সিয়াল সেক্টর
এর আওতায় রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক ও ননব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান যারা টাকা-পয়সার লেনদেনের সাথে যুক্ত।
মৌলিক সুবিধার ক্ষেত্র বা ইউটিলিটি সেক্টর
বিদ্যুৎ, পানি, প্রাকৃতিক গ্যাস, নবায়নযোগ্য শক্তি ইত্যাদি মৌলিক সুবিধার দেওয়ার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে তারা এই সেক্টরের আওতায় পড়ে।
ভোক্তা বিবেচনা মূলক ক্ষেত্র বা কনজিউমার ডিসক্রিশনারি সেক্টর
মৌলিক প্রয়োজনের বাইরে সাধারণত লাক্সারি আইটেম হিসাবে যেসব পণ্যকে বিবেচনা করা হয়, সেই সকল পণ্য নিয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করা প্রতিষ্ঠানগুলো এই সেক্টরে রয়েছ। যেমন অটোমোবাইল, কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স, হোটেল রিসোর্ট ইত্যাদি।
প্রধান ভোক্তা পণ্য দ্রব্য ক্ষেত্র
নিত্য দিনের জীবন যাপনের জন্য অপরিহার্য পণ্য নিয়ে যে সকল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে তারা এই সেক্টরের আওতায়। খাদ্য, হাইজিন প্রোডাক্টস ইত্যাদি।
এনার্জি সেক্টর
এই সেক্টরে সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি বিবিধ শক্তির উৎস থেকে তা উত্তোলন ও শোধনের কাজের সাথে যুক্ত।
হেলথ কেয়ার সেক্টর
স্বাস্থ্য পরিচর্যার সাথে জড়িত যন্ত্রপাতি ও সার্ভিস প্রদানকারী, উৎপাদনকারী এবং গবেষণায় জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো এর আওতায় রয়েছে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর
উৎপাদনমুখী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য জিনিস সরবরাহ করে থাকে এই সেক্টরের কোম্পানিগুলো। ট্রাকিং ট্রান্সপোর্টেশ, এয়ারলাইন্স, মেরিন, কমার্শিয়াল প্রিন্টিং, অফিস সাপ্লাই সিকিউরিটি ও এলার্ম সার্ভিস, রিসার্চ ও কনসাল্টিং সার্ভিস, অফিস সাপ্লাই ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত।
প্রযুক্তি ক্ষেত্র বা টেকনোলজি সেক্টর
এই সেক্টরে রয়েছে যে সকল প্রতিষ্ঠান টেকনোলজি সম্পর্কিত পণ্য ও সেবা দেয় তারা।
যোগাযোগ পরিষেবা বা কমিনিউকেশন সার্ভিসেস সেক্টর
টেলিকমিউনিকেশন সার্ভি, এডভার্টাইজি, ব্রডকাস্টি, মুভি ও এন্টারটেইনমেন্ট, ক্যাবল ও স্যাটেলাইট ইত্যাদি এই সেক্টরে রয়েছে।
বিবিধ সেক্টর
পড়া থেকে শুরু করে প্রসেস করা পর্যন্ত যে সকল প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে থাকে তারাই এই সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ও কনস্ট্রাকশন, এগ্রিকালচার, ফার্টিলাইজার ইত্যাদি এই সেক্টরের উদাহরণ।
ভূসম্পত্তি সংক্রান্ত বা রিয়েল এস্টেট সেক্টর
রিয়েল এস্টেট সংক্রান্ত সার্ভিস দেয়া, প্রপার্টি তৈরি ও বিক্রি করা যে সব প্রতিষ্ঠানের কাজ তারা এই সেক্টরের রয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজারে সাধারণ সূচক কিভাবে নির্ধারিত হয়?
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজার এ বর্তমানে কার্যকর প্রধান সূচক দুটি। এগুলো হল ডিএসই ব্রড ইনডেক্স (ডিএসই এক্স বা DSE X) এবং ডিএসই ৩০ (DSE30) । উল্ল্যেখ্য যে এর কোনটিতেই মিউচুয়াল ফান্ড, ঋণপত্র/ডিবেঞ্চার ও বন্ড অন্তর্ভুক্ত নয়। এছাড়াও আরেকটি মাধ্যমিক সূচক প্রচলিত আছে, এটি হল ডিএসই শরিয়া ইন্ডেক্স (ডিএসই এস বা DSES)। DSE X এবং DSE30 সূচক দুটি S&P DOW JONES কর্তৃক ডিজাইন করা ‘DSE BANGLADESH INDEX METHODOLOGY’ অনুসারে প্রকাশ করা হয়।
ডিএসই ব্রড ইনডেক্স (DSE X) হল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মাপকাঠি সূচক যা প্রায় ৯৭% ক্ষেত্রে পুরো ঢাকা ষ্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ার বাজার মূলধন দ্বারা প্রভাবিত হয়। তালিকাভূক্ত প্রায় সবগুলো কোম্পানিই এই সূচককে প্রভাবিত করে। এটি মূলত পূরো বাজারের গতিবিধিকে প্রতিফলিত করে।
ডিএসই ৩০ (DSE30) ইনডেক্সটি বাজার নেতৃত্ব দেয় এমন বিনিয়োগযোগ্য সেরা ৩০ টি কোম্পানির বাজার পরিস্তিতি দ্বারা প্রভাবিত। কোন কোম্পানি ডিএসই ৩০ (DSE30) সূচকে অন্তর্ভুক্ত হতে হলে তাকে অবশ্যই DSE X সূচকে আগে থেকে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।
অন্যদিকে আছে ডিএসই শরিয়া ইন্ডেক্স (ডিএসই এস বা DSES) যা তালিকাভূক্ত কোম্পানি গুলোর মাঝে যারা ইসলামী শরিয়া অর্থনীতির আলোকে পরিচালিত হয় তাদের দ্বারা প্রভাবিত সূচক। ইসলামী অর্থনীতি অনুযায়ী হারাম এমন কোনো বাণিজ্য যেমন সুদ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, মাদক উৎপাদক, বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইত্যাদি এই সূচকে অন্তর্ভূক্ত হয় না।