নতুনদের জন্য শেয়ার বাজার এ কম ঝুঁকিতে ব্যবসা করার কৌশল
বাহ্যিকভাবে দেখলে শেয়ার বাজার এ বিনিয়োগ করে অল্প সময়ে অনেক টাকা কামানো যায়, এমনটি অনেকেরই মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হল, নতুনদের জন্য শেয়ার বাজার এ বিনিয়োগ করে লাভ লস মিলিয়ে বছর শেষে পোর্টফলিও এ লাভ এ রাখাটা একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। পুরনো শেয়ার ব্যবসায়ীদের জন্য ও এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এমনকি বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার পোর্টফলিও বছরের পর বছর লসে থাকে। কোন একটি নির্দিষ্ট শেয়ার এ বিনিয়োগ করার আগে ওই শেয়ার এর আদ্যপান্ত বিশ্লেষণ করাটা অনেক বেশী জরুরী। কারন একটি ভুল শেয়ার এ বিনিয়োগ আপনার বিনিয়োগ দীর্ঘ সময়ের জন্য আটকে দিতে পারে, এমনকি অনেক আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি করে দিতে পারে।
তাহলে কি আপনার কি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা উচিত নয়? এই প্রশ্নের উত্তর হল, অবশ্যই বিনিয়োগ করতে পারেন। কিছু বেসিক বিষয় আছে যেগুলো বিশ্লেষণ করে কোন শেয়ার এ বিনিয়োগ করলে অবশ্যই শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে আপনার লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে এবং লোকসানের ঝুকি কমে যাবে। তবে অবশ্যই ধৈর্যধারন এবং অতি লোভ পরিহার করার মানসিকতা থাকতে হবে। বিশেষ করে নতুনদের জন্য শেয়ার বাজার এ বিনিয়োগের আগে এর বেসিক বিষয় গুলো ভালোভাবে জেনে বুঝে তারপর বিনিয়োগ করা উচিত।
শেয়ার এ বিনিয়োগ এর আগে জানা দরকার এমন গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ অন্য যেকোন বিনিয়োগ এর তুলনায় অনেক বেশী স্মার্ট বিনিয়োগ। এখানে আপনার নিজ বিচার বিবেচনা ও বিশ্লেষণ খাটিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে। লাভ এর মার্জিন এখানে যেমন বেশী, তেমনি ঝুঁকিও কম নেই। নিম্নে বিনিয়োগের জন্য শেয়ার নির্বাচন এর ক্ষেত্রে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল শেয়ার করা হল, যা অনুসরন করে ব্যবসা করলে নতুন শেয়ার ব্যবসায়ীরা যেমন কম ঝুঁকিতে শেয়ার ব্যবসা করতে পারেন তেমনি লাভের সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যাবে। এটা আমরা সবাই জানি, যেকোন ব্যবসায়ে লাভ এর পরিকল্পনা করতে গেলে ঝুঁকিটা যাতে কম থাকে সেটা ও মাথায় থাকতে হবে।
অবশ্যই আপনি একটি শেয়ার এ যে লাভের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করবেন, তার চাইতে এই লাভ করার জন্য কতটা ঝুঁকি নিবেন সেটা নির্ধারণ করতে হবে । এক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার লাভের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ঝুঁকির মাত্রা কম থাকতে হবে যদি আপনি শেয়ার ব্যবসায়ে সফল হতে চান।
উদাহরণস্বরূপ- X কোম্পানির শেয়ার এর বর্তমান বাজারমুল্য ১২ টাকা। এই শেয়ারটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শেয়ারটি ১২ টাকায় কিনলে আগামী ১ মাসের মধ্যে আপনি ১০% লাভে ১৩.২০ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। আর যদি কোন কারনে শেয়ারটি দাম কমে যায় তাহলে আপনি শেয়ারটি বর্তমান দাম থেকে ৫% কমলেই স্টপ লস দিয়ে বিক্রি করে দিবেন।
এখানে আপনি উক্ত শেয়ারটিতে লাভের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করলেন ১০% এবং ঝুঁকির মাত্রা ঠিক করলেন ৫%। এভাবে পরিকল্পনা করে শেয়ার কেনাবেচা করলে আপনার লাভের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে এবং লসের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।
কি কি বিষয় মাথায় রাখবেন?
- NOCPS ( নীট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো পার শেয়ার)
- EPS ( আরনিং পার শেয়ার)
- Dividend yield ( ডিভিডেন্ড ইয়েল্ড)
- RSI (রিলেটিভ স্ট্রেন্থ ইনডেক্স)
- ডিভিডেন্ড হিস্টোরি
NOCPS ( নীট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো)
NOCPS বা নীট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো হচ্ছে একটি কোম্পানির ফুয়েল এর মত যা ব্যবসা সচল রাখতে সাহায্য করে। একটি কোম্পানির নীট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো নেগেটিভ হওয়ার অর্থ সেই কোম্পানির কাছে ব্যবসা চালানোর মত নগদ টাকা নেই। এক্ষেত্রে এমনকি এই কোম্পানির বর্তমান ইপিএস পজিটিভ থাকলেও সামনে এই কোম্পানির খারাপ করার সম্ভাবনা বেশী। এবং ডিভিডেন্ড তেমন ভালো না দেয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী।
আবার EPS ও নেগেটিভ এবং NOCPS ও নেগেটিভ, এটার অর্থ এই কোম্পানির অবস্থা খুবই খারাপ। ভবিষ্যতে এই কোম্পানির ডিভিডেন্ড খারাপ দেয়ার সম্ভাবনা মোটামুটি নিশ্চিত।
EPS (আরনিং পার শেয়ার)
EPS কোন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। তবে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় নয়, এটার সাথে অবশ্যই NOCPS এবং Dividend Yield এর অবস্থা দেখতে হবে। EPS হল একটি কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় যেটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিটা কোম্পানি প্রতি ৩ মাস অন্তর বছরে ৪ বার দেয়। ইপিএস দিয়ে একটি কোম্পানির বর্তমান অবস্থা এবং সামগ্রিক অবস্থান সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারনা পাওয়া যায়।
তবে উপরে যেটা দেয়া হল, ইপিএস যদি ভালো ও থাকে, NOCPS খারাপ বা নেগেটিভ থাকলে উক্ত কোম্পানি বছর শেষে খারাপ লভ্যাংশ দেয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তাই নতুনদের জন্য শেয়ার বাজার এ বিনিয়োগের আগে EPS এবং NOCPS সম্পর্কে ধারনা থাকাটা খুবই জরুরী।
Dividend yield ( ডিভিডেন্ড ইয়েল্ড)
সোজা ভাষায় বললে, যে কোম্পানির ডিভিডেন্ড ইয়েল্ড রেশিও যত কম সেই কোম্পানির ভালো লভ্যাংশ দেয়ার সম্ভাবনা বা সক্ষমতা তত কম। আর যে কোম্পানির ডিভিডেন্ড ইয়েল্ড রেশিও যত বেশী সেই কোম্পানির ভালো লভ্যাংশ দেয়ার সম্ভাবনা বা সক্ষমতা তত বেশী। মুলত ডিভিডেন্ড ইয়েল্ড রেশিও হল একটি কোম্পানি তার শেয়ার এর ফেস ভ্যালু এর তুলনায় কত % লাভ দেয়ার সক্ষমতা রাখে। নতুনদের জন্য শেয়ার বাজার এ বিনিয়োগের আগে ডিভিডেন্ড ইয়েল্ড সম্পর্কে ভালো ধারনা থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।
ডিভিডেন্ড ইয়েল্ড রেশিও সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন।
শেয়ার মার্কেট এ ডিভিডেন্ড ইয়েল্ড সম্পর্কে জানা কেন জরুরী?
RSI (রিলেটিভ স্ট্রেন্থ ইনডেক্স)
RSI হল শেয়ার মার্কেট এ প্রচলিত একটি ইনডিকেটর যা একজন শেয়ার ব্যবসায়ীকে মার্কেট বা শেয়ার এর ট্রেন্ড বুঝতে এবং করতে সহায়তা করে। RSI মুলত একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোন শেয়ার বা মার্কেট এর overbought বা oversold অবস্থাকে ইন্ডিকেট করে যেটা দিয়ে একজন ক্রেতাকে শেয়ার কেনা বেচার ক্ষেত্রে ডিসিশন নিতে সহায়তা করে।
যদি কোন একটি নির্দিষ্ট শেয়ার এর RSI ৩০ এর নিচে চলে যায়, এর অর্থ হল শেয়ারটি অতিরিক্ত প্রাইস কমে গিয়েছে এবং RSI ৭০ এর উপরে গেলে বুঝা যায় শেয়ারটির প্রাইস অতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক মার্কেট এ মোটামুটি RSI ৩০ থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকা শেয়ার ধাপে ধাপে ক্রয় নিরাপদ যদি সংশ্লিষ্ট অন্য ইনডিকেটর গুলো পজিটিভ থাকে। অন্যদিকে RSI ৭০ এর উপরে থাকা শেয়ার ক্রয় ঝুঁকিপূর্ণ কারন শেয়ারটির মুল্য অতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছে এবং যে কোন সময় মুল্য সংশোধনের কবলে পড়তে পারে।
মার্কেট এর ইনডেক্স এর ক্ষেত্রে যদি RSI ৫০ এর নিচে থাকে তাহলে পুরো মার্কেট ডাউনট্রেন্ড এ আছে বলে ধরা হয়। RSI ৫০ এর উপরে থাকলে মার্কেট আপট্রেন্ড এ আছে বলে ধরা হয়। ডাউনট্রেন্ড এর মার্কেট এ বিনিয়োগকে কয়েক ভাগে ভাগ করে ধাপে ধাপে বিনিয়োগ করা যায় যদি শেয়ারটির অন্যান্য ইনডিকেটর পজিটিভ থাকে এবং আপট্রেন্ড মার্কেট এ লাভে বিক্রয় এর জন্য অপেক্ষা করা যায়। এটি কিছুটা মধ্যমেয়াদী বিনিয়োগ।
অন্যদিকে আপট্রেন্ড এর মার্কেট এর প্রথমদিকে বিনিয়োগ করা যায়, এতে স্বল্প সময়ে লাভ এর সম্ভাবনা ও বেশী থাকে। তবে এক্ষেত্রে স্টপ লস সেট করে নেয়া ভালো। স্টপ লস হল একটি শেয়ার কেনার পর যদি আপট্রেন্ড এ না গিয়ে ডাউনট্রেন্ড এ চলে যায় তাহলে সেটা একটা পূর্বনির্ধারিত রেটে বিক্রি করে কম লসে বের হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া । স্টপ লস আপনাকে অধিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করবে এবং অন্য আরেকটি সম্ভাবনাময় শেয়ার ক্রয় করার জন্য বিনিয়োগ ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
নতুনদের জন্য শেয়ার বাজার এ বিনিয়োগের পূর্বে তাই আরএসআই দেখে ট্রেড ডিসিশন নেয়ার বা বুঝার সক্ষমতা থাকতে হবে।
ডিভিডেন্ড হিস্টোরি
নতুনদের জন্য শেয়ার বাজার এ বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে এটা ও জানা জরুরী যে যে কোম্পানির শেয়ার এ বিনিয়োগ করবেন সেটির ডিভিডেন্ড হিস্টোরি কেমন। প্রতিটা শেয়ার মার্কেট এ এমন কিছু ভালো কোম্পানি থাকে যাদের ইপিএস, এনওসিপিএস, ন্যাভ, ডিভিডেন্ড ইয়েল্ড রেশিও যেমন পজিটিভ, একইসাথে এদের ডিভিডেন্ড হিস্টোরি ও ভালো। ভালো এবং প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণত প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে ভালো ষ্টক ও নগদ বা শুধু নগদ লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। আর দুর্বল ভিত্তির কোম্পানিগুলোর ডিভিডেন্ড হিস্টোরি ভালো হয়না। এরা প্রায় বছরই ষ্টক বা নামমাত্র নগদ লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। একেবারে দুর্বল কোম্পানিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে থাকে।
যদি আপনি শেয়ার বাজারে নতুন বিনিয়োগকারী হন এবং দীর্ঘমেয়াদী ভাল লাভের জন্য বিনিয়োগে আগ্রহী হন তাহলে ভালো ও প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি যাদের ইপিএস, এনওসিপিএস, ন্যাভ, ডিভিডেন্ড ইয়েল্ড রেশিও পজিটিভ এবং ডিভিডেন্ড হিস্টোরি ভালো, সেগুলোতে বিনিয়োগ করতে পারেন।
নতুন বিনিয়োগকারী হিসেবে শেয়ারবাজারে আর কি কি বিষয়ে ধারনা থাকা দরকার?
নতুনদের জন্য শেয়ার বাজার এ বিনিয়োগে ইপিএস, এনওসিপিএস, আরএসআই, ডিভিডেন্ড হিস্টোরি সম্পর্কে ধারনা থাকা সবচাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর পাশাপাশি আরও কিছু বিষয়ে ধারনা থাকলে বিনিয়োগ এর ভালো রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী বেড়ে যাবে।
- NAV ( নীট এসেট ভ্যালু)
- কোম্পানির মালিকপক্ষ, ইন্সটিটিউট এবং পাবলিক এর শেয়ার হোল্ডিং এর %।
- কোম্পানির অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন।
- শেয়ার মার্কেট এ কোম্পানিটি কোন ক্যাটাগরিতে আছে।
- রাইট শেয়ার, নগদ লভ্যাংশ, বোনাস শেয়ার কি, ইত্যাদি।
- স্টপ লস ঠিক করে শেয়ার কিনা।
সম্পর্কিত পোস্ট- শেয়ার ব্যবসা কি এবং শেয়ার ব্যবসায় লাভবান হওয়ার টিপস।
FAQ
শেয়ার মার্কেট এ বিনিয়োগ একটু স্মার্টলি করতে হয়। মোট বিনিয়োগর তিন ভাগের এক ভাগ লংটার্ম বিনিয়োগ (৬ মাস থেকে ১ বছর), তিন ভাগের এক ভাগ মিড টার্ম বিনিয়োগ (৩ মাস থেকে ৬ মাস) এবং এক ভাগ শর্টটার্ম ( রানিং বিনিয়োগ) বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগর রিটার্ন ভালো পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। একইসাথে লসের ঝুঁকি ও কমে আসবে।
শেয়ার বাজার এমন এক জায়গা যেখানে আপনি শত কোটি টাকা নিয়ে নামলেও সেটা পর্যাপ্ত নাও হতে পারে। তাই নতুনদের জন্য শেয়ার বাজারে একটু জেনে বুঝে বিনিয়োগ করা নিরাপদ। নতুন বিনিয়োগকারী হলে শেয়ার বাজারে প্রথম অবস্থায় ২০০০০ থেকে ৫০০০০ টাকা বিনিয়োগ করা উত্তম।
শেয়ার বাজারে কত টাকা আয় করা যায়, এটা নির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব কারণ আপনি যেসব ট্রেড করবেন তার মধ্যে কিছু লাভ হতে পারে আবার কিছু লস ও হতে পারে। আপনার লাভ করা ট্রেডের লাভের পরিমান যদি লসের চাইতে বেশী হয় তাহলেই আপনি লাভে আছেন এটা বলা যাবে। তবে শেয়ার বাজার থেকে বার্ষিক এভারেজ ২০% থেকে ২৫% লাভ করতে পারলে সেটা খুবই সন্তোষজনক লাভ বলা যেতে পারে।